০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

মিয়ানমারকে রাজি করাবে চীন

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের উপস্থিতিতে বেইজিংয়ের দ্য গ্রেট হল অব দ্য পিপলে দুই দেশের মধ্যে ঋণচুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় :এফএনএস -

বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নিতে চীন মিয়ানমারের সরকারকে সম্মত করার চেষ্টা করবে বলে ঢাকাকে আশ্বস্ত করেছে বেইজিং। গতকাল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বেইজিং এ আশ্বাস দিয়েছে।
বৈঠকে চীনের প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘস্থায়ী এ সমস্যা দ্রুত সমাধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে একমত পোষণ করে বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। লি কেকিয়াং এ সমস্যা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সমাধানেও গুরুত্বারোপ করে বলেন, চীন এ সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্রসচিব মো: শহীদুল হক চীনের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ে চীনের বন্ধু। আমরা এর আগে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দুই দেশকে সহায়তা করেছি এবং আমরা আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখব।
চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুই দেশকে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কেকিয়াং উল্লেখ করেন, চীন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দু’বার মিয়ানমারে পাঠিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনে আমরা আবারো আমাদের মন্ত্রীকে মিয়ানমারে পাঠাবো।
শহীদুল হক বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে এই শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘিœত হচ্ছে। যতই সময় যাবে এ সমস্যা ততই বড় আকার ধারণ করবে এবং এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন।
শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হবে। কেন রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমারকে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করার কিছুই নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থা করেছে। আমরা এ ব্যাপারে সব ধরনের প্রয়াস চালিয়েছি। কিন্তু রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে চায় না। কারণ, তারা শঙ্কিত যে তাদের ওপর আবারো নৃশংসতা চালানো হবে। এ শঙ্কা দূর করতে এবং রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে, মর্যাদা ও নিজস্ব পরিচয়ে নিজ দেশে ফেরত যেতে পারে সে জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে চীনের ভূমিকা পালনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তাদের জমি-সম্পত্তির ওপর অবশ্যই তাদের অধিকার থাকতে হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার দেশ এটা বুঝতে পেরেছে যে রোহিঙ্গা সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কটে মানবিক সাড়ার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
পররাষ্ট্রসচিব জানান, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা পাঁচটি বিষয়ের ওপর অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো হলো : অর্থনৈতিক বিকাশ এবং বাণিজ্য, প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিষয়, বিসিআইএম বা যোগাযোগব্যবস্থা, ভিসাসংক্রান্ত এবং রোহিঙ্গা ইস্যু। আলোচনার শুরুতে চীনা প্রধানমন্ত্রী চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান।
পররাষ্ট্রসচিব জানান, চীনা প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের অংশীদার হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, বাংলাদেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক মূল্যবান বলে মনে করি এবং এটি আরো উচ্চস্তরে নিতে চাই।
জবাবে শেখ হাসিনা বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বৈষম্য চীনের পক্ষে উল্লেখ করে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যবৈষম্য দূর করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, চীনের উচিত বাংলাদেশে আরো বেশি বিনিয়োগ করা এবং ফিরতি ক্রয়ের গ্যারান্টিসহ আরো কলকারখানা গড়ে তোলা। বাংলাদেশ ১শ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনকে বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
জবাবে লি কেকিয়াং বলেন, তারা ভারসাম্যহীন বাণিজ্য সম্পর্ক চান না এবং বাণিজ্যবৈষম্য কমিয়ে আনতে কাজ করবেন বলে আশ্বাস দেন। বর্তমানে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশী পণ্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে উল্লেখ করে লি কেকিয়াং বলেন, তারা বাকি ৩ শতাংশ পণ্যের শুল্কও ছাড় দেয়ার চেষ্টা করবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়ন, একটি জলবায়ু অভিযোজন কেন্দ্র স্থাপন এবং তিস্তা নদী সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্পদ সংগ্রহে চীনের সহযোগিতা চান। এ ছাড়া তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার দ্রুতগামী ট্রেন যোগাযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া গতিশীল করতেও চীনের সহায়তা চান।
ভিসা ইস্যু প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ ব্যবস্থার আওতায় চীনের নাগরিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভিসা দিয়ে থাকে। কিন্তু চীন ভ্রমণকারী বাংলাদেশী নাগরিকদের একই সুবিধা দেয়া হয় না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, চীন বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী বিশেষ করে ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসাপ্রক্রিয়া সহজ করবে।
অটিজম অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারসের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো: শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো: ফারুক খান দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী ‘দ্য গ্রেট হল অব দ্য পিপল’-এ চীনের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভোজসভায় যোগদান করেন।
ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে ৯টি চুক্তি স্বাক্ষর : বাংলাদেশ এবং চীন গতকাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার অংশ হিসেবে ৯টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তার জন্য এলওসি (লেটার অব এক্সচেঞ্জ) এবং অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ, সংস্কৃতি এবং পর্যটন সংক্রান্ত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক ।
গতকাল সকালে বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব পিপল-এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে এ চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়। বৈঠক শেষে দুই নেতার উপস্থিতিতে উভয় দেশের মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এতে স্বাক্ষর করেন। পররাষ্ট্রসচিব মো: শহীদুল হক এ কথা জানান।
চুক্তিগুলো হলো : ১. রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য সাহায্য সংক্রান্ত এলওসি। এর আওতায় মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য চীন ২ হাজার ৫ শ’ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করবে চীন। ২. সাংস্কৃতিক বিনিময় ও পর্যটন কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতা স্মারক। ৩. ইয়ালু ঝাংবো ও ব্রহ্মপুত্র নদের তথ্য বিনিময় সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক ও তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা। ৪. ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট। ৫. বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে অর্থনীতি ও কারিগরি সহযোগিতা বিষয়ক চুক্তি। ৬. ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা নিয়ে সমঝোতা স্মারক। ৭. পিজিসিবি প্রকল্পের আওতায় বিদ্যুৎ গ্রিড নেটওয়ার্ক জোরদার প্রকল্পের জন্য ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট।
৮. ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ নিয়ে গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন অ্যাগ্রিমেন্ট। ৯. ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ নিয়ে প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট লোন অ্যাগ্রিমেন্ট।
বাংলাদেশের সব বাণিজ্য সম্ভাবনাকে কাজে লাগান : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা ব্যবসায়ীদের দেশটির সাথে ব্যবসা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের সব সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করে কাজে লাগানোর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে তাই আমি আপনাদের বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা এবং বাণিজ্য সম্পর্কের সব সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করে কাজে লাগানোর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সন্ধ্যায় বেইজিংয়ে চায়না কাউন্সিল ফর দ্য প্রোমোশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডে (সিসিপিআইটি) চীনা ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সাথে এক গোলটেবিল বৈঠকে তার মূল প্রবন্ধে এ কথা বলেন।
সিসিপিআইটি চেয়ারপারসন গেও ইয়ান গোলটেবিল আলোচনায় স্বাগত বক্তৃতা করেন।
বাংলাদেশের রফতানি খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন যে, আগামী বছরগুলোতে চীনের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করবেন।


আরো সংবাদ



premium cement