প্রকল্পের ছড়াছড়ি শেষ একনেকে
৪০ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৭০ হাজার কোটি টাকা; গত দুই মাসে ১১৪ প্রকল্পের অনুমোদন- হামিদ সরকার
- ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০
জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। চলতি মাসেই নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত। ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদের অধিবেশনও শেষ। বাকি আছে শুধু প্রকল্প অনুমোদনের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভা (একনেক)। তারও সম্ভবত আজ রোববার শেষ বৈঠক। নির্বাচনের আগে একনেকের শেষ বৈঠকে প্রকল্পের ছড়াছড়ি। যেখানে এক বছরে অনুমোদন পেয়েছে সর্বোচ্চ ২৪৭টি প্রকল্প, সেখানে চলতি বছরের গত দুই মাসে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) অনুমোদন পেয়েছে ১১৪টি প্রকল্প। বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ রোববার সর্বোচ্চ প্রায় ৪০টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। যার বাস্তবায়ন খরচ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বলে একনেক সূত্রে জানা গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নির্বাচনের আগে কাদের তুষ্ট করতে এসব প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, তাও একটা প্রশ্ন। কারণ এসব প্রকল্প কতটা বাস্তবায়ন হবে নির্বাচনের ডামাডোলে। আবার মানহীন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও কোনো লাভ নেই।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী, আজকের একনেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব করা হচ্ছে। তবে তালিকার বাইরে সরাসরি বৈঠক টেবিলেও বেশ কিছু প্রকল্প উপস্থাপন হবে। এ একনেক ঘিরে গতকাল পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করেছেন।
একনেকের তথ্যানুযায়ী, যেখানে ২০১৪ সালের নির্বাচনের বছরে সর্বোচ্চ ১৯৮টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়, সেখানে এ বছর গত দুই মাসেই অনুমোদন পেয়েছে ১১৪টি প্রকল্প। গত ১১ সেপ্টেম্বর একনেক বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয় ১৭ হাজার ৭৮৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ১৮টি প্রকল্প। এরপরের সপ্তাহেই ১৮ সেপ্টেম্বর ১৭ হাজার ৭৮৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম মেশিন কেনাসহ ১৪টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। অক্টোবরের ৯ তারিখের একনেক বৈঠকে অনুমোদন পায় ২০টি প্রকল্প, যেগুলো বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয় ৩২ হাজার ৫২৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর এক দিন পরই ১১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশেষ একনেকে অনুমোদন পায় আরো ১৭টি প্রকল্প, যেগুলোর বাস্তবায়ন ব্যয় ১৪ হাজার ২০০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। পরে ২৩ অক্টোবরের একনেক বৈঠকে রেকর্ডসংখ্যক ২১টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। ৩০ অক্টোবরের একনেক বৈঠকে ২৪ হাজার ৭৪১ কোটি টাকার ২৪টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে তখন রেকর্ড গড়া হয়।
আজকের একনেকের তালিকায় থাকা প্রকল্পগুলো হচ্ছেÑ বাংলাদেশ রেলওয়ের জয়দেবপুর হতে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ, ব্যয় ১৪ হাজার ২৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা, পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পার্শে¦ (কুড়িল হতে বোয়ালিয়া পর্যন্ত) ১০০ ফুট প্রশস্ত খাল খনন ও উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত), ব্যয় পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা, পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ, ব্যয় তিন হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা, ঢাকা মেট্রোপলিটান এলাকায় পুলিশের জন্য ৯টি আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ, ব্যয় ৯৭৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, বাংলাদেশ পুলিশের সন্ত্রাস দমন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, ব্যয় ৩৫৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা, বাংলাদেশ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ, ব্যয় ১১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ, ব্যয় তিন হাজার ৭০৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ঢাকা খুলনা (এন-৮) মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী ইন্টারসেকশন থেকে (ইকুরিয়া-বাবুবাজার লিংক সড়কসহ) মাওয়া পর্যন্ত এবং পাচ্চর-ভাঙ্গা অংশ ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেনসহ চার লেনে উন্নয়ন প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ ব্যয় চার হাজার ১১১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ জেলা মহাসড়ক (জেড-১০৯৯) হাড়িয়াখালী থেকে শাহপরীর দ্বীপ অংশ পুনর্নির্মাণ, প্রশস্তকরণ এবং শক্তিশালীকরণ, ব্যয় ৬৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, টাঙ্গাইল পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয় ২২৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, হরিপুর শহরের টেপাখোলা লেক উন্নয়ন, কুমিল্লা জেলার ৫টি পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন, বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প- ব্যয় ৯৪৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এনহেন্স প্রজেক্ট (এলজিইডি-অংশ) ব্যয় ২২৫ কোটি টাকা, গ্রাম সড়ক পুনর্বাসন প্রকল্প, গোপালগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন (১ম সংশোধিত), ফরিদপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন (১ম সংশোধিত), বৃহত্তর ঢাকা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৪, তিন পার্বত্য জেলায় দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পল্লী সড়ক উন্নয়ন, পশ্চাৎপদ কুড়িগ্রাম ও জামালপুর জেলার দারিদ্র্য হ্রাসকরণ, ব্যয় ১৯৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা, গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ, গ্রামীণ মাটির রাস্তা টেকসইকরণের লক্ষ্যে হেরিং বোড বন্ডকরণ (এইচবিবি) (২য় পর্যায়), বঙ্গমাতা ন্যাশনাল সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার রিসার্চ সেন্টার স্থাপন, ব্যয় এক হাজার ৫০৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, মুগদা মেডিক্যাল কলেজের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি সম্প্রসারণ, ব্যয় ৫২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, সুনামগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন, ব্যয় এক হাজার ১০৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও একাডেমিক কার্যক্রম সম্প্রসারণ, ব্যয় ৮৩৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রকার যানবাহন ও যন্ত্রপাতি ক্রয়, ৬৪৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, র্যাবের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ডুবুরি ইউনিট সম্প্রসারণ, ব্যয় ১৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা, ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (১ম সংশোধন), ব্যয় দুই হাজার ৫১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা, বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ব্যয় এক হাজার ৩৭৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের উৎপাদন পদ্ধতি ওয়েট প্রসেস থেকে ড্রাই প্রসেস এ রূপান্তরকরণ (১ম সংশোধিত), ব্যয় ৮৯০ কোটি ১০ লাখ টাকা, বিএআর অব কেরু অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেড (১ম সংশোধিত), ব্যয় ১০২ কোটি ২১ লাখ টাকা।
তালিকা থেকে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের বেশির ভাগই রাস্তাঘাট, গ্রামীণ সড়ক ও অবকাঠোমো উন্নয়ন ইত্যাদি। যেহেতু সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন হবে এবং উন্নয়ন প্রকল্পের দেখভালের দায়িত্ব রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ওপর, ফলে তাদের তত্ত্বাবধানেই এসব প্রকল্পের অর্থ ব্যয় হবে। আবার চলমান কিছু প্রকল্পের সময় বাড়ানো ও ব্যয় বৃদ্ধিও করা হচ্ছে ঠিক একই মুহূর্তে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমদের মতে, রাজনৈতিক কারণেই নির্বাচনের আগে এত প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। যাতে ভোটের আগে জনগণ দেখবে প্রকল্প আসছে। অনেকটা জনতুষ্টির প্রকল্প ভোটের আগে। তবে এ সব প্রকল্পের কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, প্রকল্প যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরাীক্ষা করে করা হয়। কিন্তু এখন কতটা যাচাই করে করা হচ্ছে সেটাও প্রশ্ন। এভাবে প্রকল্প অনুমোদন দেয়াটা ঠিক না। বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ মূল্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, নির্বাচনের আগে এত প্রকল্প এসব লোকদেখানো পদক্ষেপ কি না? আদৌ এসবের জন্য কোনো বরাদ্দ হবে কি না। কাদের তুষ্ট করতে এসব প্রকল্প সেসব দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, বাস্তবায়ন করার চেয়ে সেই বাস্তবায়নের মান নিয়েও কথা থাকে। মানহীন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কোনো লাভ নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা