গুজব ছড়াচ্ছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ গ্রুপে গ্রুপে নাশকতার ছক
দেশ ডেভিলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অপারেশন চলবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা- এস এম মিন্টু
- ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সম্প্রতি গাজীপুরে ছাত্র-জনতার উপর হামলার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। প্রশ্ন উঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। হামলার আগে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন গ্রুপে গ্রুপে নাশকতার হুমকি ও গুজব ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। সেখানে নাশকতার ছকও তৈরি করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এ পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসীদের রুখতে গত শনিবার থেকে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। প্রথম দিনে ১৩০৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সাবেক প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ ৩৪৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন অপরাধে ও গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আরো ১ হাজার ১৭৮ জনকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো: ইনামুল হক সাগর। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, এই অভিযান দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে। কাউকে হয়রানি ছাড়াই সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা যৌথবাহিনী একযোগে কাজ করছে। এ সময় একটি বিদেশী পিস্তল, দু’টি ম্যাগাজিন ও ১১টি গুলিসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে রাজশাহী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভায় যোগ দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ডেভিলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এই অপারেশনটা চলবে তত দিন পর্যন্ত, যত দিন পর্যন্ত ডেভিল এখান থেকে মুক্ত না হবে।’
গত শুক্রবার রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে মারধরের শিকার হন ১৫-১৬ জন শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীরা ওই রাতে ডাকাতির খবর পেয়ে তা প্রতিহত করতে সেখানে গিয়েছিলেন। তখন তাদের মারধর করা হয়।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে যেকোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্য নিয়েই সারা দেশে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ তথা দুষ্কৃতিকারী বা শয়তান ধরার অভিযান। যৌথ বাহিনীর এই অভিযানে মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করছেন ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
গুজব ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই অভিযান ইতিবাচক ও যৌক্তিক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এই জাতীয় বিশেষ অভিযান চলমান রাখা উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অভিযান যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এরই মধ্যে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরুর পর থেকে (শনিবার রাত থেকে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দেশে গ্রেফতার করা হয়েছে মোট ২ হাজার ৮২৯ জনকে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা গতকাল বলেছেন, ‘ডেভিল (শয়তান) নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান চলবে।’ এ ছাড়া অভিযান পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাহিনীর সমন্বয়ে সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার চালু করা হয়েছে।
যৌথ বাহিনীর একাধিক গোয়েন্দা ইউনিটের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলের হয়ে যেসব সন্ত্রাসী-ক্যাডার বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে বা করার চেষ্টা করছে তাদের আটকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ-যুবলীগ বিভিন্ন অ্যাক্টিভেটের মাধ্যমে গুজব ছোড়াচ্ছে। তারা গ্রুপে গ্রুপে সক্রিয়ভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তারা নাশকতার ছক তৈরি করে তা সামাজিক যোগাযেগ মাধ্যমে প্রচার করে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে বড় ধরনের নাশকতার ছক তৈরি করেছে।
এই অভিযানের তালিকায় থাকছে শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ চিহ্নিত অপরাধীরাও। ডেভিল হান্ট পরিচালনায় গঠিত যৌথ বাহিনীর মধ্যে রয়েছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও আনসার বাহিনী। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের মহানগর ও জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) শাখাগুলো এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী-অপরাধী শনাক্তে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে।
এ বিষয়ে গতকাল পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, এই বিশেষ অভিযানের পর নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ-যুবলীগসহ অন্য নেতাকর্মীরা গাঢাকা দিয়েছে। তাদের পরিকল্পনা ছিল দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করা। ‘যারা দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করবে, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করবে বা আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করবে তাদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। তারা যেই হোক, সব খানেই অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করা হবে।’ তিনি বলেন, পুলিশের সাবেক ডিআইজি মোল্ল্যা নজরুল ও আরো তিন এসপির বিষয়ে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ ওঠার পর তাদেরও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পুলিশের কেউ জড়িত থাকলে তাকেও ছাড় দেয়া হবে না।
পুলিশের সাবেক আইজি মুহাম্মদ নুরুল হুদা নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এই জাতীয় অভিযান অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
গোয়েন্দাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে কারা কী করছেন সেটা একাধিক মাধ্যম থেকে যাচাই করে সুনির্দিষ্ট অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। কোনোভাবেই যেন নিরপরাধ বা নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হন সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
দেশ ডেভিলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অপারেশন চলবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, দেশ ডেভিলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অপারেশন চলবে। অপারেশন ডেভিল হান্টের অভিযানে রাঘববোয়াল থেকে চুনোপুঁটি কেউ ছাড় পাবে না। যারা শয়তান, তারাই ডেভিল হান্টে ধরা পড়বে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও ছাড় পায়নি, পাবেও না। রাজশাহীর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর সাথে সোমবার মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। রাজশাহী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সভাকক্ষে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, অপারেশন ততদিনই চলবে যতদিন না দেশ ডেভিলমুক্ত হবে। অপারেশন ডেভিল হান্টে কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায় সেজন্য সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ জন্য একাধিক কমিটি রয়েছে।
তিনি বলেন, আসন্ন মাহে রমজানে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় থাকবে। কারণ ছোলা, খেজুরের সরবরাহ ভালো। দেশে সারের কোনো সঙ্কট নেই, কিছু ডিলার শয়তানি করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর খামারিরা গরু উৎপাদন বাড়িয়েছে। তাই অদূর ভবিষ্যতে পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে গরু চোরাচালান অনেকাংশে কমে যাবে।
সীমান্তে ভারতীয় আগ্রাসনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের যে ভূমিকা ছিল তাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এতে খুশি, তবে আইন যেন কেউ হাতে তুলে না নেয়।
মতবিনিময় সভায় পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, রাজশাহীতে দায়িত্বরত সেনা, বিজিবি ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা