০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

কিভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে আওয়ামী লীগ

-


ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতনের পর প্রায় ছয় মাসের মাথায় গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে লিফলেট বিতরণ, হরতাল-অবরোধসহ একগুচ্ছ কর্মসূচি দিয়েছে দলটি। অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে এবারই প্রথম বড় ধরনের কর্মসূচির ডাক দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিদেশ বসে বিবৃতির মাধ্যমে এত বড় কর্মসূচি ডেকে আওয়ামী লীগ কিভাবে তা বাস্তবায়ন করবে, কর্মসূচি বাস্তবায়নের ধরন কি হবে, কিভাবে সফলতা আসবে- এসব নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনসহ দেশের সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা চলছে।

২৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ এক বিবৃতির মাধ্যমে ফেব্রুয়ারিজুড়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-
১ ফেব্রুয়ারি শনিবার থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার পর্যন্ত লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি, ৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ, ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিক্ষোভ, মিছিল-সমাবেশ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি রোববার অবরোধ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এমনটি নয়, ওইদিনই জনরোষ থেকে রক্ষা পেতে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং তখনকার সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও সরকারের সব পর্যায়ের মন্ত্রী-এমপি আত্মগোপনে চলে যান। নেতামন্ত্রীদেরও একটি বড় অংশ বিদেশে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন। যারা দেশে রয়েছেন তাদের সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ এখনো প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ ডেকে অংশগ্রহণ করেননি। এমনকি যারা দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে রয়েছেন- তাদের মধ্যে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: দীপু মনি, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ আরো কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলছেন, শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই বিদেশ অবস্থান করছেন, একটি অংশ কারাগারে রয়েছেন আবার আরেক অংশ আত্মগোপনে রয়েছেন, এমতাবস্থায় বড় ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ আসলে কি করতে চাইছেন? এমন প্রশ্ন রাজনৈতিক সচেতন মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আওয়ামী লীগের এ কর্মসূচি ডাকা হয়েছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে। এটা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদেশে বসে ও আত্মগোপনে থেকে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের দাবির পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে আজ পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ সারা দেশে লিফলেট বিতরণ ও বিক্ষোভ-সমাবেশ পালনেরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ১৬ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, এস এম কামাল হোসেনসহ অন্তত এক ডজন নেতাকে ব্যক্তিগত মোবাইলে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। কারো কারো হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলেও তা রিসিভ করেননি। অবশ্য একটি বিদেশী গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, ‘জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া এই অবৈধ সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই।’ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বেশির নেতা যেখানে কারাবন্দী ও পলাতক রয়েছেন, সেখানে কর্মসূচি সফল হবে কীভাবে- এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলাসহ নানা কারণে দেশের মানুষ আজ অতিষ্ঠ। এই অবৈধ সরকারের হাত থেকে মানুষ মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়। তাই মানুষকে রক্ষা করার জন্য, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমরা এই কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছি।” বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, “আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের দল। জনগণের স্বার্থে, জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এই আন্দোলন কর্মসূচি। এতে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষরাই এই হরতাল-অবরোধ পালন করবে। পাশাপাশি প্রতিটি এলাকায় আমাদের কর্মী-সমর্থকরা প্রস্তুত রয়েছেন। সাধারণ মানুষের দাবি আদায়ে তারাও মাঠে থাকবেন এবং আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এই কর্মসূচি পালন করব।”

নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার কথা কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বললেও তৃণমূল পর্যায়ে একটু ভিন্ন সুর দেখা যায়। খোদ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মূল চালিকাশক্তি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ঠিকমতো নির্দেশনা পাননি। আবার কেউ নির্দেশনা পেলেও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মসূচি গ্রহণ করার বিপক্ষে। তাদের মতে, শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ জেলে, অন্যরা পলাতক। এ অবস্থায় নেতৃত্বশূন্যতায় চরম দিশেহারা তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও ৫ আগস্টের পর মামলা-হামলার ভয়ে ঘরছাড়া, কেউ কেউ বাসায় থাকেন, আবার কেউ কেউ ভয়ে আশপাশে গা ঢাকা দিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। ঢাকার নেতাকর্মীদের বেশির ভাগ নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। মাঝেমধ্যে নানা প্রয়োজনে আড়ালে আবডালে ঢাকায় আসেন, কাজ সেরে আবার চলে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধ্যম সারির এক নেতা বলেন, বিদেশে অবস্থান করা নেতাদের সাথে মাঝেমধ্যে কথা হয়। কর্মসূচি দিয়ে বসে আছেন অথচ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকায় আর্থিক দৈন্যদশায় দু’বেলা ঠিকমতো খাবারও পাচ্ছেন না। নেতাদের কাছে দুর্দশার কথা বললে তারা দু-পায়সা দিয়েও সাহায্য করেন না। তাহলে কর্মসূচি বাস্তবায়ন হবে কিভাবে?

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো: মিরাজ হোসেনের সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, নেতাকর্মীরা তো এমনিতেই বিপদের মধ্যে আছেন। ঘর থেকে বের হলে গ্রেফতার হতে হয়, মামলা হামলার আশংকাতো আছেই। বিচ্ছিন্নভাবে আগের মতো কিছু জায়গায় ঝটিকা মিছিল হবে। লিফলেট বিতরণ -এ অবস্থায় করা কী সম্ভব? মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের আরেক নেতা আরিফুর রহমান রাসেল বলেন, কর্মসূচি বাস্তবায়নের ব্যাপারে মহানগর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক প্রলয় সমদ্দার বাপ্পী নয়া দিগন্তকে বলেন, কেন্দ্রের নির্দেশনা আছে কর্মসূচি বাস্তবায়নের। যেভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে সেভাবেই নেতাকর্মীদের পালন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা বিদেশে আছেন তারা জীবনের নিরাপত্তার জন্য রয়েছেন। আগেতো জীবন বাঁচাতে হবে! পরিস্থিতির শিকার হয়ে তারা বিদেশে গেছেন। ন্যূনতম রাজনৈতিক অধিকার এ দেশে চালু হলে উনারা আবার দলকে পুনর্গঠিত করার জন্য দেশে ফিরে আসবেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল