আ’লীগকে অন্তত ৩টি নির্বাচনের বাইরে রাখা উচিত
- খালিদ সাইফুল্লাহ
- ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩২, আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:২৫
আওয়ামী লীগ বিগত তিনটি নির্বাচনে যেভাবে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে, মানুষকে ভোট দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে, সেভাবে তাদেরকেও আগামী তিনটি নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া ঠিক হবে না বলে মনে করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। তিনি বলেন, আগামীতে আওয়ামী লীগকে অন্তত তিনটি নির্বাচনের বাইরে রাখা উচিত।
গত ২৬ জানুয়ারি রোববার ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেন। নিচে তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-
নয়া দিগন্ত : বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে তাতে আপনারা কতটুকু সন্তুষ্ট?
পীর সাহেব চরমোনাই : জুলাই-আগস্ট গণ-অভুত্থানের ফসল হলো বর্তমান সরকার। এ সরকার একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এসেছে। তাদের প্রতি মানুষের অনেক আশা আকাক্সক্ষা ছিল। কিন্তু তারা ছাত্র-জনতার সে আশা আকাক্সক্ষা ঠিকমতো পূরণ করতে পারছে না। বিপ্লবের পর সব কিছু এলোমেলো ছিল। তখন যাদের উপদেষ্টায় আনা হয়েছে তা সঠিকভাবে আসেনি। তাদের অনেকটা দুর্বলতা আমরা লক্ষ্য করছি। এ জন্য আমরা সরকার গঠনের পরই অনেকগুলো ষড়যন্ত্র দেখেছি। আল্লাহ সেটা থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন। এ জন্য কয়েকজন উপদেষ্টার বিষয়ে আমরা আপত্তিও জানিয়েছি। আর সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী সরকার যে অপশাসন করেছে সেসব তারা ভারতের চাহিদা অনুযায়ী করেছে। ভারতকে সন্তুষ্ট করতে সংবিধান, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে, যা আমাদের দেশের উপযোগী নয়। এ জন্য যদি সংস্কার না করে নির্বাচন হয় তাহলে যে লাউ সেই কদুর মতো হয়ে যাবে। আগের মতোই ফ্যাসিবাদী কায়দায় সব কিছু চলবে। এতে বিপ্লবের কোনো সুফল জাতি পাবে না।
নয়া দিগন্ত : জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ডিক্লারেশন নিয়ে আপনাদের অভিমত কী?
পীর সাহেব চরমোনাই : এত হাজার হাজার লোক জীবন দিলো, আহত-পঙ্গু হলো, তাদের একটি আশা-আকাক্সক্ষা ছিল। সেই আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলন যদি না থাকে তা হতে পারে না। তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হওয়া অবশ্যই দরকার। আর এটি অবশ্যই সবার মতামত নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতে হবে।
নয়া দিগন্ত : সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে আপনারা কোনটার পক্ষে? কত দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করেন।
পীর সাহেব চরমোনাই : সংস্কারের আগে নির্বাচন হয় কি করে? সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। এর পর যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। তবে এর জন্য বেশি কালক্ষেপণ করা যাবে না। এ জন্য আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি। এর মধ্যেই সংস্কারও সম্ভব এবং নির্বাচনও করা সম্ভব।
নয়া দিগন্ত : আপনারা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের কথা বলছেন। কোনো কোনো দল বিরোধিতা করছে, আবার কোনো কোনো দল মনে করে এ পদ্ধতি আসলে আওয়ামী লীগ অনেক আসন পেয়ে যাবে। ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসবে। এ বিষয়ে আপনাদের অভিমত কী?
পীর সাহেব চরমোনাই : আসলে বাস্তবতা হলো আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসার মতো পরিবেশ নেই। তাদের আসার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগের অধীনে গত তিনটি নির্বাচনে সঠিকভাবে ভোট হয়নি। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। এ জন্য আওয়ামী লীগ অন্তত তিনটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলে আমরা মনে করি। এ ছাড়া তারা যেভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, গুম-খুন করেছে, আয়নাঘর তৈরি করে মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন করেছে, এর বিচার হতে হবে। আদালতে যদি এসব অন্যায়ের বিচার হয় তা হলে আমাদের আশা আওয়ামী লীগ আদালতের আদেশের মাধ্যমেই আগামীতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। আর বর্তমান সময়ে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন খুবই প্রয়োজন। কারণ বিগত নির্বাচনগুলোতে আমরা দেখেছি, সব দল ভোট পেলেও সব ভোটারের প্রতিনিধি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না। শুধুমাত্র যে দলের প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোট পাচ্ছে তিনি সংসদে যাচ্ছেন। অন্য প্রার্থীরা তার কাছাকাছি ভোট পেলেও তিনি যেসব ভোটারের ভোট পেয়েছেন তাদের ভোটের কোনো মূল্য থাকছে না। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সব ভোটারের ভোটের মূল্যায়ন হবে এবং সব দলের প্রতিনিধি সংসদে থাকবে। সেখানে সৎ-যোগ্য ব্যক্তিদেরই দলগুলো মনোনয়ন দেবে। এতে একটি কার্যকর ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় সরকার গঠিত হবে।
নয়া দিগন্ত : আগের পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আপনারা কতটি আসনে প্রার্থী দিবেন?
পীর সাহেব চরমোনাই : আমরা আশা করছি আগামী নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতেই হবে। আর যদি না হয় তা হলে যখন নির্বাচন আসবে তখন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
নয়া দিগন্ত : সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বরিশালের চরমোনাই গিয়েছেন। আপনার সাথে বৈঠকও করেছেন। এটাকে কিভাবে দেখছেন?
পীর সাহেব চরমোনাই : বরিশালে জামায়াতে ইসলামীর একটি কর্মসূচি ছিল। সে উপলক্ষে তাদের আমির ডা: শফিকুর রহমান বরিশালে গিয়েছিলেন। তখন তিনি আমাদের চরমোনাইতে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি ছারছিনা এবং নেসারাবাদেও গিয়েছিলেন। তিনি চরমোনাইতে যাওয়ার কারণে চরমোনাইয়ের ব্যাপারে জামায়াতের লোকজনের মধ্যে যে ধারণা ছিল সেটি স্বচ্ছ হয়েছে এবং সুন্দর একটি পরিবেশও তৈরি হয়েছে। তারা চরমোনাই সম্পর্কে জানতে পেরেছে, এতে ভালো হয়েছে।
নয়া দিগন্ত : জামায়াতের সাথে আপনাদের নির্বাচনী ঐক্য হবে কি না? এতে অন্যান্য ইসলামী দল থাকবে কি না?
পীর সাহেব চরমোনাই : আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। নির্বাচনে ইসলামের পক্ষে একটি বাক্স যাওয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের চাহিদা আছে। সবাই চায় ইসলামের পক্ষে একটি বাক্স আসুক। এ জন্য আমরা অনেক আগে থেকেই ইসলামী দলগুলোর সাথে আলোচনা করছি। জামায়াতের সাথেও আলোচনা হয়েছে। আমরা ওইভাবে ঐক্যের কথা বলছি না, তবে একটি নির্বাচনী সমঝোতায় যাওয়ার চেষ্টা করছি। জামায়াতের সাথেও এ সমঝোতা হতে পারে।
নয়া দিগন্ত : জামায়াতের সাথে জোটে গঠনে আকিদাগত কোনো সমস্যা হবে কি না?
পীর সাহেব চরমোনাই : আমাদের ব্যাপারেও তাদের নানা কথা আছে। বিভিন্ন জায়গায়-মিডিয়ায় তাদের কর্মীদের আমাদের সম্পর্কে বলতে শুনেছি। তাদের ব্যাপারেও আলেম-ওলামাদের কথা আছে। তবে আমি মনে করি এক জায়গায় বসে আলোচনা করতে করতে এক সময় ভালো পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে।
নয়া দিগন্ত : বিএনপির সাথে আপনাদের নির্বাচনী জোট নিয়ে কোনো আলোচনা চলছে কি না?
পীর সাহেব চরমোনাই : বিএনপির সাথে জোট গঠন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। ইসলাম নিয়ে তারা ইতঃপূর্বে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আমরা দুঃখিত। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি ইসলাম সম্পর্কে যেসব নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন তা অত্যন্ত আপত্তিকর। তিনি ইসলামী রাজনীতিকদের মৌলবাদী বলেছেন; কুরআনের ভিতরে রাজনীতি নেই; ইসলামের সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই; এ রকম কথা বলেছেন। তিনি এর থেকে ফিরে আসবেন আমরা এটা প্রত্যাশা করি। তবে তাদের সাথে গত ২৭ জানুয়ারির বৈঠকে ইসলামী শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া ও ইসলামবিরোধী কেউ কোনো কথা না বলাসহ ১০ বিষয়ে দুই দলের ঐকমত্য হয়েছে।
নয়া দিগন্ত : আগামীতে দেশে ফ্যাসিবাদের বিলুপ্তি ও সুশাসন আসার সম্ভাবনা কতটা আছে বলে আপনি মনে করেন?
পীর সাহেব চরমোনাই : যদি আগের পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় তাহলে ফ্যাসিবাদ আবারো আসার সুযোগ তৈরি হবে। এক কথায় জাতির মধ্যে যদি মৌলিক পরিবর্তন না আসে, বিশেষ করে ইসলাম ও মানবতাবাদী পরিবেশ না হয় তাহলে পরিস্থিতি আগের মতোই থেকে যাবে। এ জন্যই আমরা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলছি। এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে এককভাবে কোনো দল ক্ষমতায় যেতে পারবে না। তখন নতুন করে ফ্যাসিবাদ কায়েম হওয়ার আশঙ্কাও কমে যাবে।
নয়া দিগন্ত : দেশে যারা ইসলামী রাজনীতি করেন তারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন বলে অনেকে বলে থাকেন। এ ছাড়া তাদেরকে মৌলবাদীও বলা হয়। এ ব্যাপারে আপনাদের অভিমত কী?
পীর সাহেব চরমোনাই : আওয়ামী লীগ বলেছিল ক্ষমতায় গেলে কুরআন-বিরোধী কোনো আইন করবে না। কিন্তু তারা করেছে। নির্বাচনের সময় আসলে তারা মাথায় হিজাব-টুপি পরে, মাজারে গিয়ে নির্বাচনী কাজ শুরু করে। আবার তারাই ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম করে। এটাই হলো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। আমরা ধর্ম পালন করি। আমরা বলছি দেশে ইসলামী শাসন কায়েম হলে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম থাকবে না। শিশুরা যেভাবে মায়ের কোলে থাকে সংখ্যালঘুরা সেভাবে নিরাপদ থাকবে। ভারতে যেভাবে মৌলবাদী মোদির শাসনে মুসলিম সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয় বাংলাদেশে সেভাবে হবে না। তারা অন্যান্য মুসলিম নাগরিকদের মতোই বসবাস করতে পারবে। আপানারা দেখেছেন গত ৫ আগস্টের পর দেশে শুধু ধর্মের কারণে কোনো হিন্দু ধর্মের মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়নি, শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে যেসব হিন্দু বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে বিরোধী দলের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছে তারাই পাল্টা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তবে সে সংখ্যাটাও কম। বরং সে সময় সংখ্যালঘুরা যাতে নির্যাতনের শিকার না হয় সে জন্য ইসলামী দলগুলো তাদের বাড়িঘর-মন্দির পাহারা দিয়েছে।
নয়া দিগন্ত : অনেকে বলে থাকেন দেশে ইসলামী শাসন আসলে দেশ পিছিয়ে যাবে। আপনারা কি মনে করেন?
পীর সাহেব চরমোনাই : ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু যারা প্রগতিশীল তারা ইসলামবিদ্বেষী। তারা মুসলিম ধারার বাইরে অন্য চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী বলেই এ ধরনের মনোভাব পোষণ করেন। বরং ইসলামী শাসন আসলে দেশ আরো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে।
নয়া দিগন্ত : ইসলামী শাসন থাকলে নারী স্বাধীনতা থাকবে না বলে বলা হয়। এটা আসলেই ঘটবে কি না?
পীর সাহেব চরমোনাই : দেশে নারীরাই ইসলামকে বেশি পছন্দ করে। তারাই নির্বাচনে আমাদের ভোট দেয়। কারণ তারাই ভালো করে জানে ইসলাম নারীদের কতটা সম্মান দিয়েছে। কিন্তু দেশে নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করতে চায় কিছু দল। তারা নারীদের উন্নয়নের কথা বলে ঘরে ঘরে অশান্তি তৈরি করতে চায়, অধিকারের কথা বলে উলঙ্গ করতে চায়।
নয়া দিগন্ত : শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত?
পীর সাহেব চরমোনাই : দেশে ৯২ ভাগ মুসলমান। এ জন্য ইসলামী শিক্ষার প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। অন্যান্য ধর্মের লোকও তাদের নিজ ধর্ম শিক্ষা করবে। যার যার ধর্ম সে জানবে। আমরা যদি ধর্মের ব্যাপারে না জানি তা হলে চর্চা করবো কিভাবে? এ জন্য ধর্মীয় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।