১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০২ মাঘ ১৪৩১, ১৫ রজব ১৪৪৬
`

প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজসহ সদস্যরা প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন : পিআইডি -

- রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি
- অন্তর্বর্তী সরকারকাঠামো প্রস্তাব
- নতুন পাঁচ মূলনীতি
- দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
- সব বিভাগে হাইকোর্ট
- নিরাপত্তা কাউন্সিলের সুপারিশ

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো এবং ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। শেখ হাসিনার সময়ের চার মূলনীতিকে পরিবর্তন করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে মূলনীতি নির্ধারনের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সাথে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা এবং অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করা হয়েছে। বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের সংস্কারের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এ সময় কমিশনের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এ দিন প্রধান উপদেষ্টার কাছে আরও তিনটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনটি কমিশন হলো নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ তাঁদের প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে জানান, তাঁরা সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের সুপারিশ করেছেন। এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর সুপারিশ করেছেন। সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই আলোচনার মাধ্যমে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে। ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই আলোচনা হবে বলে আজ এক সংবাদ ব্রিফিংয়ের সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সংবিধান সংশোধনের সুপারিশে সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনাকে প্রতিস্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। নতুন ভাষ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ, যারা এই ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি”। ভাষ্যে আরো বলা হয়েছে, ‘‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের যে আদর্শ বাংলাদেশের মানুষকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীনতার যে আদর্শ ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করেছিলো, সেই সকল মহান আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে; সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করছি।’’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া নাগরিকত্ব প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি’ মর্মে অনুচ্ছেদ ৬(২) সংশোধন করে “বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন” হিসেবে প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। সংবিধান বিষয়ক অপরাধ ও সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতা সংক্রান্ত কমিশন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক এবং ৭খ বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে কমিশন।

কমিশন সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলি বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে।
কমিশন সংবিধানের অধিকার সম্পর্কিত অনুচ্ছেদসমূহ পর্যালোচনা করে বেশ কিছু সুপারিশ প্রস্তাব করছে। বিদ্যমান সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের অধিকারসমূহ সমন্বিত করে ‘মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা’ নামে একটি একক সনদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আদালতে বলবৎযোগ্য হবে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার ও নাগরিক, রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে বিদ্যমান তারতম্য দূর করবে।
কমিশন সংবিধানে বিদ্যমান অধিকারের অনুচ্ছেদসমূহের সংস্কার করে বৈষম্য নিষিদ্ধকরণের সীমিত তালিকা বর্ধিতকরণ, জীবনের অধিকার রক্ষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, জামিনে মুক্তির অধিকার অন্তর্ভুক্তকরণ এবং নিবর্তনমূলক আটক সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংস্কার কমিশন একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করে বলেছে এর একটি হবে নি¤œকক্ষ জাতীয় সংসদ এবং আরেকটি উচ্চকক্ষ । উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে ৪ বছর। এর মধ্যে নি¤œকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে নি¤œকক্ষ গঠিত হবে। ৩০০ জন সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। আরো ১০০ জন নারী সদস্য দেশের সকল জেলা থেকে এই মর্মে নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনী এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো নি¤œকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০% আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে। সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ বছর করা হবে।
কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ২ জন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যাদের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। একজন সংসদ সদস্য একই সাথে প্রধানমন্ত্রী, সংসদনেতা, ও রাজনৈতিক দলের প্রধান এর মধ্যে যেকোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না। অর্থবিল ব্যতীত নি¤œকক্ষের সদস্য দের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সবসময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে; এর মধ্যে ১০০ জন সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ জন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে। এই ১০০ জন প্রার্থীর মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন আইন দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবে। অবশিষ্ট ৫টি আসন পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে (যারা কোনো কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন) প্রার্থী মনোনীত করবেন। কোনো রাজনৈতিক দলকে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বের যোগ্য হতে হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের অন্তত ১% নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চকক্ষের স্পিকার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের একজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন যিনি সরকার দলীয় সদস্য ব্যতিত উচ্চকক্ষের অন্য সকল সদস্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন।
সংবিধান সংশোধনী প্রসঙ্গে কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে, সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে, এটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটের ফলাফল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন কোন আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে। সুপারিশ অনুসারে রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নি¤œকক্ষ অভিশংসন প্রস্তাবটি পাস করার পর তা উচ্চকক্ষে যাবে এবং সেখানে শুনানির মাধ্যমে অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

নির্বাহী বিভাগ গঠন সম্পর্কে কমিশন বলেছে, আইনসভার নি¤œকক্ষে যে সদস্যের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন আছে তিনি সরকার গঠন করবেন। নাগরিকতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা দ্বারা প্রয়োগ করা হবে। তবে কমিশন রাষ্ট্রপতির কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের সুপারিশ করছে এই বিশেষ কার্যাবলী কিংবা সংবিধানে উল্লেখিত বিষয় ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করবেন।
কমিশন রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়ন এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (“এনসিসি”) গঠনের সুপারিশ করছে। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল “এনসিসি” রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এনসিসি-র সদস্য হবেন: রাষ্ট্রপতি; প্রধানমন্ত্রী; বিরোধীদলীয় নেতা; নি¤œকক্ষের স্পিকার; উচ্চকক্ষের স্পিকার; বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি; বিরোধী দল মনোনীত নি¤œকক্ষের ডেপুটি স্পিকার; বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার; প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধিত্বকারী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের উভয় কক্ষের সদস্যরা ব্যতীত আইনসভার উভয় কক্ষের বাকি সকল সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাদের মধ্য থেকে মনোনীত ১ জন সদস্য। আইনসভা ভেঙ্গে গেলেও, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শপথ না নেওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান এনসিসি সদস্যরা কর্মরত থাকবেন। আইনসভা না থাকাকালীন এনসিসির সদস্য হবেন রাষ্ট্রপতি; প্রধান উপদেষ্টা; বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি; প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদের দুই জন সদস্য।
এনসিসি রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশনের প্রধান সহ অন্যান্য কমিশনার; অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলগণ; সরকারী কর্ম কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার; প্রতিরক্ষা-বাহিনীসমূহের প্রধান; আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো পদে নিয়োগে নাম প্রেরণ করবেন।
সংস্কার কশিনের সুপারিশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে ৪ বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুই বারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচক মন্ডলীর (ইলেক্টোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। নির্বাচক মন্ডলী গঠিত হবে - আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্যপ্রতি একটি করে ভোট; প্রতিটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট (৬৪ টি ভোট) আর প্রতিটি ‘সিটি কর্পোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিক ভাবে একটি করে ভোট। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নি¤œকক্ষ থেকে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।

সুপারিশ অনুসারে, আইনসভার নি¤œকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হবেন। আইনসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে যদি কখনো প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা আস্থা ভোটে হেরে যান কিংবা অন্য কোনও কারণে রাষ্ট্রপতিকে আইনসভা ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতির নিকট এটা স্পষ্ট হয় যে, নি¤œকক্ষের অন্য কোন সদস্য সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন অর্জন করতে পারছেন না, তবেই রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষ ভেঙে দেবেন।
একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুই বার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিনি একাদিক্রমে দুই বা অন্য যে কোনোভাবেই এই পদে আসীন হন না কেন তাঁর জন্যে এ বিধান সমভাবে প্রযোজ্য হবে। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। কমিশন আইনসভার মেয়াদ শেষ হবার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙ্গে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেয়া পর্যন্ত, একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করছে; এই সরকারের প্রধান ‘প্রধান উপদেষ্টা’ বলে অভিহিত হবেন। আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন পূর্বে অথবা আইনসভা ভেঙ্গে গেলে, পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন। অন্তর্র্বতী সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৯০ দিন হবে, তবে যদি নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হয় তবে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শপথ গ্রহণমাত্র এই সরকারের অবসান ঘটবে।

কমিশনের সুপারিশ অনুসারে পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে আইনসভার সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে- এনসিসি-র ৯ সদস্যের মধ্যে নূন্যতম ৭ সদস্যের সিদ্ধান্তে এনসিসি-র সদস্য ব্যতিত নাগরিকদের মধ্য হতে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব না হলে, সকল অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্য থেকে একজন গ্রহণযোগ্য এনসিসি-র ৯ সদস্যের মধ্যে নূন্যতম ৬ সদস্যের সিদ্ধান্তে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এভাবেও সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব না হলে, এনসিসি-র সকল সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এ প্রক্রিয়ায় এনসিসি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। এভাবে না হলে তাঁর অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। একইভাবে তাঁকেও না পাওয়া গেলে পর্যায়ক্রমে অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। আর এভাবে যদি কোন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে না পাওয়া যায় তবে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। যদি তাও না হয় তবে তাঁর অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারক প্রধান উপদেষ্টা হবেন। একইভাবে তাঁকেও না পাওয়া গেলে পর্যায়ক্রমে অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারক প্রধান উপদেষ্টা হবেন।

কমিশন উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সকল বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ার সম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন রাজধানীতেই থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন [জুডিশিয়াল অ্যাপয়েনমেন্টস কমিশন-জেএসি) গঠন করা হবে। এর সদস্যরা হবেন - প্রধান বিচারপতি; আপিল বিভাগের পরবর্তী দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারক; হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারপতি; অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সংসদের উচ্চকক্ষ কর্তৃক মনোনীত একজন নাগরিক। কমিশন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হওয়ার জন্য উপযুক্ত জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারীর পাশাপাশি সততা ও সত্যনিষ্ঠার শর্ত অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছে। আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ-জ্যেষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটি বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে কমিশন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল থাকবে। তদন্ত ও অনুসন্ধানের জন্য অভিযোগ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে প্রেরণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপ্রধানের পাশাপাশি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (ন্যাশনাল কনস্টিটিউশন কাউন্সিল, এনসিসি)-এর থাকবে।

কমিশন ‘অধস্তন আদালত’–এর পরিবর্তে ‘স্থানীয় আদালত’ ব্যবহারের প্রস্তাব করছে। একই সাথে সুপারিশ করছে যে, স্থানীয় আদালতের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, ছুটি এবং শৃঙ্খলাসহ সকল সংশ্লিষ্ট বিষয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত থাকবে। এই লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে একটি বিচারিক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করছে। সংযুক্ত তহবিলের অর্থায়নে সুপ্রিম কোর্ট এবং স্থানীয় আদালতের প্রশাসনিক কার্যক্রম, বাজেট প্রণয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর এই সচিবালয়ের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
কমিশন সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত সকল কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কার্যকরী স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার সুপারিশ করছে। কমিশন প্রতিটি জেলায়, পারস্পরিক কার্যক্রমের সমন্বয়ের লক্ষ্যে একটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করছে যা সেই জেলার মধ্যে সকল এলজিআই-এর জন্য একটি সমন্বয় এবং যৌথ কার্য সম্পাদনকারী সংস্থা হিসাবে কাজ করবে। সংস্কার কমিশন একটি স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করছে যা একজন প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনার এবং ৪ জন কমিশনার নিয়ে গঠিত হবে।
কমিশন সংবিধানের অধীন একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করছে। সে সাথে পাঁচটি সাংবিধানিক কমিশন নিয়ে সংবিধানের একটি ভাগ তৈরির জন্য সুপারিশ করছে। এই কমিশনগুলো হচ্ছে; মানবাধিকার কমিশন; নির্বাচন কমিশন; সরকারি কর্ম কমিশন; স্থানীয় সরকার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রত্যেকটির মেয়াদ হবে ৪ বছর।
কমিশন সুপারিশ করছে যে, কেবলমাত্র এনসিসি-র সিদ্ধান্তক্রমে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। কমিশন মনে করে, জরুরী অবস্থার সময় নাগরিকদের কোন অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না এবং আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না। তাই কমিশন অনুচ্ছেদ ১৪১খ ও অনুচ্ছেদ ১৪১গ বাতিলের সুপারিশ করছে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement