১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১১ রজব ১৪৪৬
`

ভারতের সব চুক্তির প্রকাশ দাবি

জাতীয় প্রেস ক্লাবে সর্বজনকথার সেমিনারে আলোচকরা : নয়া দিগন্ত -

বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভারতের সাথে করা সামরিক, বেসামরিক সব চুক্তি জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। একই সাথে চুক্তিগুলোর মধ্যে যেগুলো জনস্বার্থবিরোধী, সেগুলো বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
তারা বলেন, এই সরকারের বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতে পাই যে, চুক্তি বাতিল করা যাবে না। পুরনো চুক্তি, প্রকল্প থাকবে কিন্তু আমরা একটি নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করব, তা হতে পারে না। দেশব্যাপী অধিকাংশ মানুষের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে পূর্ববর্তী সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তের দায় বাংলাদেশের জনগণ নিতে বাধ্য না।
গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে সর্বজনকথার আয়োজনে ‘বাংলাদেশে ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্য : স্বরূপ এবং করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সেমিনারের সভাপতি ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। এতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। সভা সঞ্চালনা করেন গবেষক মাহা মির্জা।
প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা বাংলাদেশে ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে যে সমঝোতার মধ্য দিয়ে ভারত এবং সেদেশের কিছু ব্যক্তির পুঁজির স্বার্থ পূরণ হচ্ছে, সেসব চুক্তি ও সমঝোতা বাতিল করার দাবি তোলেন। সীমান্তে হত্যা নিয়ে বহুপক্ষীয় ফোরামে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। একই সাথে ট্রানজিট চুক্তি, রামপাল চুক্তি, বিদ্যুৎ চুক্তিসহ বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
কল্লোল মোস্তফা বলেন, ভারত বিভিন্ন অসম চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে, আবার চুক্তি স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। যার উদাহরণ হলো তিস্তা চুক্তি। শুধু তিস্তা নয়, কোনো ধরনের চুক্তি বা সমঝোতা ছাড়াই ভারত বাংলাদেশের ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ওপর ৩০টির বেশি নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সরকার ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ দিয়ে ১২টি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প চূড়ান্ত করেছে। বাংলাদেশের নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ আবার উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সঞ্চালন করবার সমঝোতা করেছে বাংলাদেশের সাথে। অথচ বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের ‘ওয়াটার কোর্স কনভেনশন ১৯৯৭’ স্বাক্ষর করেনি।
মোশাহিদা সুলতানা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারতনির্ভরতার স্বরূপ তুলে ধরে বলেন, দেশব্যাপী অধিকাংশ মানুষের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে পূর্ববর্তী সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তের দায় বাংলাদেশের জনগণ নিতে বাধ্য না। বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন প্রকল্প যেমন, বহরমপুর-পাবনা সঞ্চালন লাইন প্রকল্প, সূর্যমনি-কুমিল্লা সঞ্চালন লাইন, আদানির ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, রিলায়েন্স এলএনজিভিত্তিক মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতা, উৎপাদন এবং এই প্রকল্পগুলোর জাতীয় স্বার্থের বিরোধী। সেই সাথে জ্বালানি খাতের বিভিন্ন প্রকল্প যেমন ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিশোধিত তেল আমদানি, এলএনজি আমদানির প্রকল্পগুলোর আর্থিক লাভ-ক্ষতি এবং এইগুলোর কৌশলগত ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই সব প্রকল্প বাতিল করার দাবি জানান।
অধ্যাপক তানজিমউদ্দীন খান বলেন, ভারতের সব থেকে বড় সংবেদনশীলতার জায়গা তার সেভেন সিস্টার। যার কারণে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে বারবার রাজ্য বনাম কেন্দ্রের যে ঠেলাঠেলি তা অনেকটাই রাজনৈতিক। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। তাই তিস্তা চুক্তি করার সমস্ত এখতিয়ার আছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের। তাই তিনি দ্রুততম সময়ে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করার দাবি জানান। সেই সাথে তিনি ভারতের সাথে করা সমস্ত চুক্তি জনসমক্ষে উন্মোচন করার দাবি করেন।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ভারত প্রসঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আছে। একটা বৃহৎ রাষ্ট্রের পাশে একটা রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, বিভিন্ন সময়ে তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে ভারত রাষ্ট্র। এইটাই মূল সমস্যা। এই আধিপত্য থেকে বের হতে হলে আধিপত্যের সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো জানতে হবে এবং জনমত তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত রাষ্ট্র তার সেই সময়ের কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ভারতের মানুষ সহমর্মিতা নিয়ে সেই সময় বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমরা অবশ্যই সেই সহযোগিতার কথা স্মরণ করব এবং সেই সাথে ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরোধিতা আমরা করব। শেখ হাসিনার আমলে শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করার কারণ শেখ হাসিনার দরকার ছিল নির্বাচন ছাড়া চিরস্থায়ী ক্ষমতা তৈরি।
আনু মুহাম্মদ আরো বলেন, এই সরকারের প্রয়োজন সামরিক, বেসামরিক সব চুক্তি জনগণের কাছে প্রকাশ করা। সেইসব চুক্তির মধ্যে যেগুলো জনস্বার্থবিরোধী সেইগুলো বাতিল করা। কিন্তু এই সরকারের বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতে পাই যে, চুক্তি বাতিল করা যাবে না। পুরনো চুক্তি, প্রকল্প থাকবে কিন্তু আমরা একটি নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করব, তা হতে পারে না।
ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারত যদি ট্রানজিট ব্যবহার করে তাহলে ভারতের মধ্য দিয়েও বাংলাদেশের ট্রানজিট ব্যবহার করতে পারতে হবে। কোনো অসম চুক্তি বাংলাদেশ চায় না।
তিনি বলেন, ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়বে যদি আধিপত্যের সুনির্দিষ্ট বিষয়কে পাশ কাটিয়ে অন্য দিকে মনোযোগ সরিয়ে দেবার প্রবণতা থাকে। ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্য হিন্দু-মুসলমান বিষয় না। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে সংহতি স্থাপনের মাধ্যমেই এই অঞ্চলে ভারতের আধিপত্যকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।


আরো সংবাদ



premium cement