১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ৯ রজব ১৪৪৬
`

মধ্যরাতে বিশেষ আদালতে আগুন

এজলাস পুড়ে যাওয়ায় বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত
ঢাকা আলিয়া মাদরাসা মাঠে আগুনে পুড়ে যাওয়া অস্থায়ী বিশেষ আদালত : নয়া দিগন্ত -

পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসার মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতের এজলাসে মধ্যরাতে ভাঙচুর, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে পুড়ে গেছে আদালতের সব নথিপত্র। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অস্থায়ী এই আদালতে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল। এজলাস পুড়ে যাওয়ায় বিচারপ্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল এক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি (পিপি) বোরহান উদ্দিন জানিয়েছেন, এই আদালত এখন সংস্কার না করলে বিচারকার্যক্রম সম্ভব নয়। মামলার পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করবেন আদালত। এর আগে বুধবার রাতে আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা অস্থায়ী এই আদালত সরিয়ে নেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তারা টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ জানায়। বিক্ষোভ চলাকালে বিশেষ আদালতের এজলাসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এদিকে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত, চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের কারামুক্তি, ন্যায়বিচার নিশ্চিত, চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল ও পুনর্বাসনের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে অবরোধ করেন ভুক্তভোগী বিডিআর সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। গতকাল সকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসতে থাকেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। বেলা ১টার দিকে তারা বিভিন্ন দাবিতে শাহবাগ ‘ব্লকেড’ করেন। এতে শাহবাগ মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শাহবাগ মোড়-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সড়কে তৈরি হয় তীব্র যানজট। বিকেল সাড়ে ৩টায় ফের শাহবাগ ছেড়ে শহীদ মিনারে অবস্থান নেন আন্দোলকারীরা। এ ছাড়া দাবি না মানলে আজ শুক্রবার ও শনিবার গণসংযোগ করার ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে রোববার সারা দেশের সব জেলায় মানববন্ধন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
বিশেষ আদালতের এজলাসে আগুন : বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতের এজলাসকক্ষ পুড়ে যাওয়ায় গতকাল পিলখানার বিস্ফোরক মামলার শুনানি হয়নি। সাড়ে ১৫ বছর আগে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলায় গতকাল আলিয়া মাদরাসার বিশেষ আদালতে আসামিদের জামিন শুনানি হওয়ার কথা ছিল। তবে মাদরাসা মাঠে অস্থায়ী আদালত বসানোর প্রতিবাদে বুধবার দিবাগত রাত থেকে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। ভোর রাতে অস্থায়ী আদালতের এজলাসসহ বিভিন্ন অবকাঠামোতে আগুন দেয়া হয়। গতকাল সকালে সড়কে টায়ার জ্বালিয়েও বিক্ষোভ করেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি (পিপি) মো: বোরহান উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, পিলখানায় হত্যাকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলাটি ঢাকা মহানগর প্রথম অতিরিক্ত দায়রা আদালতে চলমান। বকশীবাজারে এই অস্থায়ী আদালতে মামলাটি চলছিল। গতকাল এ মামলায় আসামিদের জামিন শুনানির জন্য দিন ধার্য ছিল। সকালে আদালতের বিচারক মো: ইব্রাহীম মিয়া ও উভয়পক্ষের আইনজীবীরা সেখানে আসেন। তারা পুড়ে যাওয়া এজলাস ঘুরে দেখেন। আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৯ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন। তবে, শুনানি কোথায় হবে সে বিষয়ে এখনো সরকারের কোনো নির্দেশনা বা গেজেট তারা পাননি।
তিনি আরো বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয়ের গেজেট মোতাবেক আলিয়া মাদরাসা মাঠে গতকাল শুনানির কথা ছিল। এসব কারণেই আমাদের সেখানে যাওয়া। কিন্তু আমরা সেখানে গিয়ে যে অবস্থায় এজলাস দেখেছি তাতে নিশ্চিত হলাম যে এখানে কোনোভাবেই বিচারকাজ বা আদালতের দাফতরিক কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়। এখন সরকার যদি আদালতের স্থান নির্ধারণ করে দেন তাহলে সেখানে এ মামলার বিচারকাজ চলবে।’
আগুন নেভাতে বাধাগ্রস্ত ফায়ার সার্ভিস : ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার লিমা খানম বলেন, ‘রাত ৩টা ১০ মিনিটে বকশীবাজারে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে আগুনের খবর পেয়ে আমাদের দু’টি ইউনিট পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে বিক্ষোভকারীদের বাধার মুখে আমাদের কর্মীরা ভেতরে ঢুকতে পারেনি। পরে ভোর ৫টার পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভেতরে গেলেও কাজ করতে হয়নি। ততক্ষণে এজলাসকক্ষ পুড়ে গেছে। পরবর্তীতে বেলা ১১টায় সেখানকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা সেখানে যান।
বিচারকাজ চললে শিক্ষাকার্যক্রম বিঘœ হয়: বুধবার রাত থেকে শিক্ষার্থীরা আলিয়া মাদরাসা মাঠে অবস্থান নেন। গতকাল সকালে তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মোড়, পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার, বকশীবাজার অরফানেজ রোড ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে যায় সেনবাহিনী ও পুলিশ। শিক্ষার্থীদের দাবি, বিচারকাজ চলমান থাকলে শিক্ষাকার্যক্রম বিঘœ হয়। এর আগে বেশ কয়েকবার মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেয়ার পরও সমাধান হয়নি।
গতকাল দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, বেলা সোয়া ১টার দিকে মাদরাসা মাঠের ফটক বন্ধ। ভেতরে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সপ্তাহের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান চলছিল।
আন্দোলনকারীরা যা বললেন : এই কর্মসূচিতে অবস্থান নেয়া চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য নুরুল আমিন বলেন, আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য এখানে এসেছি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আশ্বাস না পেলে আমরা রাজপথ ছাড়ব না। আমাদের অনেক ভাই এখনো জেলে আছেন, তাদের মুক্ত করে আমরা রাজপথ ছাড়ব।
কর্মসূচি চলাকালে আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আরিয়ান বলেন, ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দিয়ে আপনারা (সরকার) ক্ষমতায় গেছেন। এসি রুমে টিভি স্ক্রিনের সামনে বসে শাহবাগের অবস্থা দেখছেন, কিন্তু শাহবাগে এসে কথা বলতে পারছেন না। ছাত্রদের ন্যায্য দাবি না মানার কারণে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে, আপনারাও সেই পথে হাঁটবেন না। সেই পথে হাঁটলে শেখ হাসিনার মতো অবস্থা আপনাদেরও হবে।
শাহবাগ অবরোধে তীব্র যানজট : ভুক্তভোগী পরিবারের ৯ দাবিতে গতকাল রাজধানীর শাহবাগে ‘ব্লকেড’ করা হয়েছে। এতে শাহবাগ মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শাহবাগ মোড় থেকে গুলিস্তান, ধানমন্ডি, ফার্মগেট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সড়কে তৈরি হয় তীব্র যানজট। বিকেল সাড়ে ৩টায় আন্দোলনকারীরা শাহবাগ ছেড়ে ফের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা হুসনেয়ারা বেগম বলেন, দুপুরের পর থেকে তীব্র যানজটে মৎস্যভবন এলাকায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বসে আছি। গাড়ির জটলা এখনো শেষ হচ্ছে না। আরো কত সময় যে লাগবে যানজট শেষ হতে। সে অপেক্ষায় আছেন এই যাত্রী। সদরঘাট থেমে মিরপুর রুটে চলা তানজিল পরিবহনের এক চালক বলেন, দেশে কোথাও কোনো দাবি আদায়ের জন্য কিছু হলে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শাহবাগের মতো ব্যস্ত এলাকা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন পুরো রাজধানীজুড়ে তীব্র যানজট তৈরি হয়।
এর আগে, গত বুধবার রাত থেকে একই দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা। এদিন দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করলে শাহবাগ মোড়ে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন তারা। পরে সেখান থেকে তাদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে যায়। সেখান থেকে বিকেলে ফিরে ‘ন্যায়বিচারের আশ্বাস’ না পেলে শাহবাগ অবরোধের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা।
পিলখানা হত্যামামলার তথ্য : ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দফতরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে ৪৬৮ জনের মুক্তি আটকে আছে।


আরো সংবাদ



premium cement