মধুমতি ব্যাংকে টাকা রেখে ‘মানি মার্কেটে’ ব্যবসা করেছেন তাপস
এ যেন নতুন হর্ষদ মেহতা- খালিদ সাইফুল্লাহ
- ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০
গত শতকের নব্বইয়ের দশক। ভারতের এক আলোচিত নাম ছিলেন হর্ষদ মেহতা। সেই অ্যানালগ যুগেও শেয়ারবাজারকে আঙুলের ওপরে নাচাতে শুরু করেছিলেন তিনি। তাকে বলা হতো ‘শেয়ার মার্কেটের অমিতাভ বচ্চন’! তার বিরুদ্ধে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল। ৫৪ দিন জেলে থাকার পর ২০০১ সালের ৩০ ডিসেম্বর কারাগারেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। গুজরাটের রাজকোটে এক সাধারণ ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেয়া হর্ষদের ‘দ্য বিগ বুল’ হয়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর ছিল এসিসি সিমেন্ট সংস্থায় বিনিয়োগ। এসিসির শেয়ারদর যেখানে ছিল দুই শ’ টাকা। সেখানে তিন মাসের মধ্যে শেয়ারের দর লাফিয়ে পৌঁছে যায় প্রায় ৯ হাজার টাকায়! রাতারাতি বিপুল মুনাফা হর্ষদকে করে তুলল বিজনেস টাইকুন! কিন্তু কোন ম্যাজিকে সম্ভব হলো এমনটা? ১৯৯২ সালে সেই রহস্য ভেদ করেন সাংবাদিক সুচেতা। হর্ষদ প্রথমে ব্যাংক রসিদ অর্থাৎ বিআর তৈরি করিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সেই টাকাই অবৈধ ভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে দিতেন। পরে অন্য কোনো শেয়ার থেকে লাভ করতে পারলেই ব্যাংককে তাদের টাকা ফিরিয়ে দিতেন। এভাবে নানা টেকনিক্যাল ফাঁকফোকর বের করে ব্যাংকের জমা টাকা শেয়ারবাজারে লাগাতে শুরু করেন তিনি। যেমন ব্যাংক ‘ক’ শেয়ার বিক্রি করতে চায়। অন্যদিকে ব্যাংক ‘খ’ শেয়ার কিনতে চায়। এবার হর্ষদ মেহতা ‘ক’ ব্যাংকের কাছে গিয়ে জানালেন, তিনি একজন ক্রেতা পেয়েছেন। এরপর তিনি ব্যাংকটি থেকে রসিদ তুলে এক সপ্তাহ সময় চাইলেন। আর সেই সময়ে ‘খ’ ব্যাংককে গিয়ে জানালেন তিনি বিক্রেতা পেয়েছেন। এরপর সেই ব্যাংকের থেকে এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নগদ টাকা নিজের কাছে রাখলেন। এভাবে কিছু সময়ের জন্য তার কাছে বিআর এবং নগদ টাকা সবই চলে এলো। আর এই কাজে তাকে পুরোদস্তুর সাহায্য করতেন বিভিন্ন ব্যাংক কর্মচারী। পর্যায়ক্রমে পুরো বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই সব ব্যাংক হর্ষদের থেকে টাকা ফেরত চাইতে শুরু করে। আর তার জেরে শেয়ারবাজার মুখ থুবড়ে পড়ে। বহু ব্যাংক থেকেই মোটা টাকা তুলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন হর্ষদ। রাতারাতি এত টাকা ফেরত দিতে না পেরে ক্রমেই বেকায়দায় পড়ে যান। একের পর এক অভিযোগ জমা পড়তে থাকে। রুজু হয় মামলা। ভরাডুবির সেই সূচনা হর্ষদের।
আলোচিত এ ঘটনার আদলে নিজের পরিচালনাধীন মধুমতি ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখে ‘মানি মার্কেটিং’ করার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পলাতক সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে। সাড়ে চার বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা মধুমতি ব্যাংকে এফডিআর করে রাখেন তাপস।
জানা যায়, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হন শেখ হাসিনার ভাইপো ব্যারিস্টার তাপস। দায়িত্ব নিয়েই নিজের মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে ৪০ কোটি টাকা রেখে ডিএসসিসির লেনদেন শুরু করেন। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের কাছ থেকে তোলা হোল্ডিং ট্যাক্স ও ট্রেড লাইসেন্সের কোটি কোটি টাকা তার ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হতো। যেখান থেকে ব্যাংক লাভ পেলেও ডিএসসিসির কোনো লাভ ছিল না। ডাচবাংলা ব্যাংক, জনতা, সোনালী ও প্রিমিয়াম ব্যাংকে ডিএসসিসির অ্যাকাউন্ট থাকলেও মেয়র তাপসের আগ্রহ বেশি ছিল মধুমতি ব্যাংকের দিকেই।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০৩ কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৭৯ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক হাজার ৩২ কোটি টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক হাজার ৬১ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে ডিএসসিসি। এর মধ্যে ৪৯ ভাগ টাকা আদায় হয় মধুমতি ব্যাংকের মাধ্যমে। এছাড়া কোনো প্রকল্প হলেই তার টাকা মধুমতি ব্যাংকে রাখতেন তিনি। ডিএসসিসির বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ঠিকাদারদের কাছ থেকে প্রতি বছর কয়েক শ’ কোটি টাকা জামানত হিসেবে রাখা হতো। সে টাকা এফডিআর করে রাখা হতো মধুমতি ব্যাংকে। তিন মাস পরপর এফডিআর এর মেয়াদ শেষ হলে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় টাকা নিয়ে আবার বাকি টাকা নতুন করে এফডিআর করতো ডিএসসিসি। এভাবে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা এফডিআর করে রাখা হতো। বর্তমানে ওই ব্যাংকে প্রায় সাড়ে চার শ’ কোটি টাকা জমা রয়েছে। পিপিআর অনুসারে কাজ শেষ হওয়ার পর জামানতের টাকা এক বছর জমা রাখার নিয়ম থাকলেও ব্যারিস্টার শেখ তাপস মেয়র হয়ে দুই থেকে আড়াই বছর জমা রেখে তারপর ওই টাকা ফেরত দিতেন। এভাবে দীর্ঘদিন মধুমতি ব্যাংকে টাকা জমা রেখে সেই টাকা দিয়ে ব্যাংককে ব্যবসা বা ‘মানি মার্কেটিং’ করার সুযোগ করে দিতেন মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ওই টাকা বিনিয়োগ করে লাভ করতো মধুমতি ব্যাংক ও তার পরিচালক শেখ তাপস। এভাবে গত সাড়ে চার বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ‘মানি মার্কেটিং’ করেছেন মেয়র তাপস ও তার ব্যাংক।
ডিএসসিসির কয়েকজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। এতে ব্যাংকগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। বর্তমানে গ্রাহকরা টাকা চেয়ে পাচ্ছেন না। মেয়র তাপস নিজের ব্যাংকে টাকা রেখে ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এমনকি ওই ব্যাংকের মাধ্যমে নেতা-মন্ত্রীদের টাকা পাচারের সুযোগ করে দিয়েছিলেন কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত বলেও তারা মনে করেন।
ডিএসসিসির ঠিকাদার যুবলীগ নেতা আমিনুল হক বিপ্লব নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্যারিস্টার তাপস ভারতের হর্ষদ মেহতার কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানি মার্কেটিং করেছেন। তিনি ছিলেন একজন সাধু বেশে শয়তান। সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী কোন ক্রয় কাজের বিপরীতে জামানত রাখতে হয় মোট কাজের ১০ শতাংশ টাকা। যদি ৬০০ কোটি টাকার কোনো প্রকল্প হয় তাহলে যে ঠিকাদার কাজ পাবেন তার কাছ থেকে ৬০ কোটি টাকা জামানত রাখা হয়। যেটি পিপিআর এর নিয়ম অনুসারে এক বছর জমা রাখার কথা। কিন্তু মেয়র তাপস টাকা জমা রাখতেন দুই-তিন বছর। এ টাকা তিনি তার নিজের মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে জমা রাখতেন এবং সেখান থেকে তিনি ওই টাকা বিনিয়োগ করে বিভিন্নভাবে লাভ করতেন।
ডিএসসিসির প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র সাহা নয়া দিগন্তকে বলেন, মেয়র সাঈদ খোকনের সময় জামানতের টাকা ছয় মাস থেকে এক বছর ডিএসসিসির অ্যাকাউন্টে জমা রাখা হতো। ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সময় সেটি দুই বছর করা হয়। বর্তমানে প্রশাসক এক বছর করার নির্দেশনা দিয়েছেন। মধুমতি ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে ডিএসসিসির বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের হোল্ডিং ট্যাক্স ও ট্রেড লাইসেন্সের টাকা নেয়া হতো জানিয়ে তিনি বলেন, কবে মধুমতি ব্যাংকেই বেশি টাকা রাখা হতো। নারায়ণ চন্দ্র বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স ও ট্রেড লাইসেন্সের টাকা গ্রহণ করা ব্যাংক থেকে ১৫ দিন পরপর আমাদের নিয়মিত অ্যাকাউন্ট থাকা ব্যাংকে টাকা আনা হতো। সেখান থেকে আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ ডিএসসিসির নিজস্ব অন্যান্য খরচ করতাম। যেসব ব্যাংকে আমাদের হোল্ডিং ট্যাক্স ও ট্রেড লাইসেন্সের টাকা জমা হতো সেখান থেকে আমরা কোনো লাভ পেতাম না। শুধুমাত্র লেনদেনের সুবিধা পেতাম। তবে ডিএসসিসির হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেয়র তাপস মধুমতি ব্যাংকে টাকা এফডিআর করে রাখতেন বেশি। এতে ব্যাংকটিকে লাভ করার সুযোগ করে দেন তিনি। নতুন প্রশাসক আসার পর ঢাকা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সেখানে টাকা এফডিআর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য মধুমতি ব্যাংককে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করছে।
মধুমতি ব্যাংকে সর্বশেষ জমা থাকা ৪৭০ কোটি টাকার মধ্যে গত সপ্তাহে ৪১ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন তারা।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, মেয়র তাপসের সময় ঠিকাদারদের অনেক টাকা বকেয়া ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা এখন জামানতের টাকা ফেরত নিতে প্রতিনিয়ত নগর ভবনে ভিড় জমাচ্ছেন। প্রশাসক প্রথমে টাকা দিতে একটু সময় নেন। বর্তমানে তাদের টাকা ফেরত দেয়া হচ্ছে। গত দুই মাসে ঠিকাদারদের প্রায় ৬০ কোটি টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। মধুমতি ব্যাংকে এখনো অনেক টাকা জমা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে তারা সময় নিচ্ছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা