২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
এনওয়াইটি প্রতিবেদন

স্বৈরশাসক সরিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

-


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বৈরাচার হটিয়ে নতুন একটি অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। দেশের সর্বস্তরের জনতার সমর্থনে তারা দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে ছাত্রনেতারা বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা তুলে ধরেছেন। ন্যায্যতা, সমতা ও আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র বিনির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তরুণ শিক্ষার্থীরা।

২৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত এ প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে, ‘দিস স্টুডেন্টস আউস্টেড আ গভর্মেন্ট, নাউ দে আর রি-বিল্ডিং আ ডেমোক্র্যাসি’। এতে বলা হয়, সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় একটি বাণিজ্যিক ভবনের প্রথম তলায় নয়া অফিসে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরিকল্পনা করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ শিক্ষার্থী। মাত্র কয়েক মাস আগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎখাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর মধ্যে ছিলেন এই তরুণরা। হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে কর্তৃত্ববাদ, বর্বরতা ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ। তার পতনের পর বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে সুযোগ এসেছে তা কাজে লাগাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষার্থীরা। প্রক্রিয়াটি যত দীর্ঘ বা যত জটিলই হোক না কেন দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালীভাবে পুনর্গঠনে কাজ করে যাবেন তারা। দেশে এমন একটি ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে। এ ছাড়া আর কখনই যেন দেশ স্বৈরাচারের কবলে না পড়ে সে বিষয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ছাত্রনেতারা। ২৬ বছর বয়সী তরুণ ছাত্রনেতা আরিফ সোহেল বলেছেন, আমাদের রাজনৈতিক শক্তি এখন খুবই তরল অবস্থায় আছে। ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর জয়ের আশা ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, আমরা স্থিতিশীল এবং অগ্রগতিশীল একটি দেশ চাই।

নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছে, ৫৩ বছর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণ কঠিন কাজ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। তাদের মধ্যে রয়েছেন নিজের ক্যারিয়ারে সফল ব্যক্তিরা এবং তরুণ ছাত্রনেতারা যারা প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে ইতিহাস নির্মাণের ভার বহন করছেন।

শেখ হাসিনার আমলে নিপীড়িত একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল চাইছে কোনো রকম সংস্কার ছাড়াই আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নির্বাচন দেয়া হোক। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তেল, চালসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় চরম দুর্ভোগে জনগণ। অন্য দিকে ঢাকায় ক্রমাগত বিক্ষোভের ফলে ভোগান্তিতে রয়েছে রাজধানীবাসী। বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর কথিত হামলার খবরে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। পাশাপাশি ইসলামের নামে চরমপন্থীদের উত্থানের আশঙ্কাতেও রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও অল্প সময়ের মধ্যে পুরনো ব্যবস্থার উৎখাত হয়েছে- তবে সংস্কারের জন্য সময়ের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বে থাকা ছাত্রনেতারা হয়তো কোনো বিলাসী জীবন পাবেন না।

শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, সংস্কার চলছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরের সময় উল্লেখ করে মাহফুজ বলেন, নতুন সরকারের প্রথম দুই মাস কিছু স্থবিরতা ছিল। কেননা, তখন সরকারকে আইনশৃঙ্খলার ওপর বাড়তি নজর দিতে হয়েছে। তবে বর্তমানে সংস্কার কাজ চলছে এবং অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়ে উঠছে বলে জানিয়েছেন তরুণ এই ছাত্রনেতা। জুলাই অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ধারণার জন্য বেশ পরিচিত ২৬ বছর বয়সী মাহফুজ। কেননা আন্দোলনের আগেই ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের বিলুপ্তি এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ ধারণাটি উপস্থাপন করেছিলেন তিনি। রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের এই দেশে ছাত্রনেতারা বাম ঘরানার বিপ্লবী রাজনীতির ভাষার প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।

মাহফুজ বলেন, বর্তমানে নির্বাচনী বিধিমালা হালনাগাদের মতো দৃশ্যমান স্বল্পমেয়াদি সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আরো অনেক সংস্কার রয়েছে, যেমন- সরকারে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং দেশের তরুণদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা। তবে এ ক্ষেত্রে আরো সময় প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, দেশের ১৭ কোটি ১০ লাখ মানুষের প্রায় ৮০ শতাংশই কর্মক্ষম, সবার কর্মসংস্থান তৈরিতে সময়ের প্রয়োজন। এর আগে এক সাক্ষাৎকারে ক্ষুদ্রঋণের জন্য বিখ্যাত ৮৪ বছরের ড. ইউনূস বলেছেন, জনগণের পূর্ণ সমর্থনেই তার সরকার গঠিত হয়েছে। সংস্কারে ধীরগতির জন্য তার সরকারের সমালোচনার জবাবে এ কথা বলেন তিনি। ড. ইউনূস বলেন, কয়েক বছর সময় লাগলেও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছাত্ররা সক্ষম।

একটি ‘নৈতিক দায়িত্ব’ : সেপ্টেম্বরে মোট ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন ড. ইউনূস। যেগুলোর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা বেশির ভাগই শিক্ষাবিদ, সরকার এবং নাগরিক সমাজের বিশেষজ্ঞ। তাদের সাথে ছাত্রনেতারাও যুক্ত রয়েছেন। তবে এসব কমিশন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দেয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে পুলিশ এবং বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার এবং দুর্নীতি হ্রাস ও জনপ্রশাসনের উন্নয়নের বিষয়ে সুপারিশ দেবে সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলো। অন্তর্বর্তী সরকার বড় আইডিয়া দিতে চাইছে। তারা মনে করে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। কারণ জনগণ এবং রাজনীতিবিদদের তরফ থেকে এই ব্যাপক পরিবর্তনে তাদের প্রতি সমর্থন আছে। তারাই পরবর্তী সরকারে নেতৃত্ব দেবে।

ই-মেইলের মাধ্যমে নিজেদের মতামত জানিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। সেখানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতার দাবি উঠেছে। নির্বাচন কমিশন সংস্কারের দায়িত্বে থাকা বদিউল আলম বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান বা কার্যালয় পরিচালনার জন্য কী কী যোগ্যতা প্রয়োজন সেটা তারাই (জনগণ) ভালো বুঝবেন। তবে আমি মনে করি উচ্চশিক্ষিত মানুষও সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং খারাপ হতে পারে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান হিসেবে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি কয়েক দশক ধরে দেশের অবৈধ অর্থের প্রবাহের ওপর খেয়াল রাখছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য তাকেই দায়িত্ব দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি মনে করেন সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যক্তিকেই দায়িত্ব দেয়া উচিত। ইলিয়ন স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, দেশকে সাহায্য করা নিজের ‘নৈতিক দায়িত্ব’। তার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানকে ‘সমতা, মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের’ ভিত্তি হিসেবে রচনা করা। সংবিধান পুনর্লিখন হবে নাকি সংশোধন করা হবে- এমন বিতর্ককে স্বাগত জানিয়েছেন ডা: আলী রীয়াজ। তবে যারা হাসিনার ‘অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের’ অংশ ছিলেন বা ওই শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন তাদের ব্যাপারে সতর্ক রয়েছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে আলী রীয়াজ যুক্তি দিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন জার্মানি পুনর্গঠিত হয়েছে- তখন নাৎসিদের সাথে কী কথা বলা হয়েছিল?

চতুর্মুখী চাপ : সোমবার গণহত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করতে হাসিনাকে ভারত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত চেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এ বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি দিল্লি। সাম্প্রতিক একটি ইউটিউব ভিডিওতে দেখা যায়, শেখ হাসিনা ভারতে বসে বাংলাদেশি হিন্দুদের কথিত ‘গণহত্যার’ জন্য ড. ইউনূসকে দায়ী করেছেন। হাসিনার সাথে ভারত সরকারের উগ্রপন্থী সমর্থকরাও একই দাবি করেছেন। তবে আইনজীবী গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক এ ধরনের অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক’ বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, সহিংসতার সময় হিন্দুদেরকে আলাদা করে বেছে বের করা হয়নি। এই সহিংসতায় বাংলাদেশে কয়েক শত মানুষ নিহত হয়েছেন। ড. ইউনূসের সরকার যে বার্তা দিয়েছে তিনি তার কাছাকাছিই রয়েছেন। বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯ ভাগ মানুষ হিন্দু। তিনি আশা করেন, দেশ পুনর্গঠনের আলোচনার টেবিলে এই জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত।

ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অস্থিরতার বৃহৎ কারণ হচ্ছেন শেখ হাসিনা। ভারতে হাসিনা থাকতে চান, থাকুন। তবে তিনি যেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো হস্তক্ষেপ না করেন- সে বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইউনূস। এরপর থেকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন উভয় দেশের কর্মকর্তারা। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আরেকটি চাপ হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল)। সংস্কার কমিশন থেকে বাদ পড়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে শেখ হাসিনার ঘোর শত্রু সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান পরিচালিত দলটি। বিএনপি বলছে, সংস্কার বা নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রদানে খুব ধীরগতি দেখাচ্ছেন ড. ইউনূস। যদিও গত সপ্তাহে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছেন তিনি। প্রস্তাবিত সংস্কারের উপর ভিত্তি করে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৫ সালের শেষে অথবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে হতে পারে বলে জানিয়েছেন ড. ইউনূস।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেয়া উচিত। কেননা, অনির্বাচিত সরকার বহু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ এবং বিক্ষোভের দিকে ইঙ্গিত করেন, যেসব বিক্ষোভের মধ্যে অটোরিকশা চালকদের আন্দোলনও ছিল। এ ছাড়া দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের জন্য একটি অতিরিক্ত চাপ। সম্প্রতি এক সকালে ঢাকায় একটি সরকারি ট্রাকের সামনে শতাধিক নাগরিককে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নাসিমা নামের একজন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘এখান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পণ্য নেয়া যায়, তবে আমি যদি বাজার থেকে এসব নিতে চাই তাহলে দ্বিগুণ দাম পড়বে।’

ছাত্রনেতাদের ভবিষ্যৎ “ সংসদ ভবনের একটি কোণে হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর রচিত বইয়ের বিশাল এক স্তূপ দেখা যায়। শহরজুড়ে প্রায় ৩৫ হাজার বই রয়েছে, যার প্রতিটিই শেখ মুজিবের জীবনী গ্রন্থ। ছাত্রদের উদ্ধৃত করে ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, তিনি কোনো দেবতা নন। বিক্ষোভের সময় যে ভাঙচুর হয় তা এখন থেমে গেছে। শিক্ষার্থীরা আবার তাদের পড়ালেখা এবং ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগী হয়েছেন। সংস্কার কমিশনে থাকা একমাত্র নারী শিক্ষার্থী নিশাত জামান নিহা বলেছেন, তিনি সুযোগ পেলেই উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনা শুরু করবেন। মাহফুজ আলম বলেছেন, দায়িত্ব শেষে আবার তিনি তার আগ্রহের জায়গা ভাষা এবং ইতিহাসের কাজে ফিরে যাবেন।


আরো সংবাদ



premium cement