খেয়ালখুশিমতো খরচ হয়েছে জলবায়ু তহবিলের অর্থ
- কাওসার আজম
- ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩৮
- রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া হয় প্রকল্প, সুফল পাননি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা
- ৮৭৪ কোটি টাকা পদ্মা ব্যাংকে আটকা
- অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করার সিদ্ধান্ত আছে : রিজওয়ানা হাসান
খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালী গ্রামের মৃত্যুঞ্জয় রায়। পেশায় একজন কৃষক। লবণাক্ততার কারণে তার জমিতে আগে তেমন আবাদ হতো না। তবে, গত বছর থেকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ‘ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলনা কৃষি অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন’ প্রকল্পের মাধ্যমে সেই সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে বলে জানান। এই প্রকল্পের আওতায় জমির ভেতর ছোট পুকুর খননের পর বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা সেচ কাজে ব্যবহার করছেন তিনি। মৃত্যুঞ্জয় জানান, আগে জমিতে পানির অভাবে কিছুই হতো না। এবার ৪ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছি। জমির পাড়ে সবজি চাষ করেছি। ধান কেটে আবার তরমুজ লাগাবো। কিন্তু, সমস্যা হলো খাবার পানিতে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটি এনজিও’র ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (পানি শোধনাগার) রয়েছে, সেখান থেকে পানি কিনে খেতে হচ্ছে তার পরিবারকে।
শুধু মৃতুঞ্জয় নন, তার মতো ওই গ্রামের প্রায় সব পরিবারকেই হেঁটে, রোদ বৃষ্টি মাড়িয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। অনেককে আবার কয়েক কিলোমিটার হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। খুলনা, সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে খাবার পানির জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। অথচ জলবায়ু পরির্বতনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ জানেন না ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট (বিসিসিটি)’ বা জলবায়ু তহবিল নামে কোনো কিছু আছে। এই তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য বিগত সময়ে তেমন কিছু না করলেও রাস্তার সড়ক বাতি স্থাপন, পার্ক তৈরি, পুকুরের ঘাট বাঁধানো, এমনকি জলবায়ুর টাকায় ভবন তৈরি করে তা ব্যক্তিগত রিসোর্টে পরিণত করারও নজির আছে। যেমনটা হয়েছে ভোলার চরফ্যাশনে ‘জ্যাকব টাওয়ার’ নির্মাণে। জলবায়ু ট্রাস্টের টাকায় স্থানীয় এমপির (তৎকালীন) নামে সুউচ্চ এই টাওয়ার তৈরি করা হয়। ভোলার চর কুকরি-মুকরিতেও জলবায়ু প্রকল্পের টাকায় বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় বলে জানা যায়।
পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার তেলিখালি ইউনিয়নে জলবায়ু তহবিলের টাকায় ইকো রিসোর্টের নামে ১০০ বিঘা জমিতে একটি ব্যক্তিগত রিসোর্ট ও পার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। উপজেলা সদরের রিজার্ভ পুকুরের চারপাশে ওয়াকওয়ে এবং ঘাটও বানানো হয় এই ফান্ডের টাকায়। ওই পুকুরে রঙিন মাছ, পানির ফোয়ারাও বানানো হয়েছে। একইভাবে জলবায়ু ট্রাস্টের তহবিলের ২৯ কোটি টাকায় খুলনার রূপসায় গড়ে তোলা হয়েছে শেখ রাসেল ইকো পার্ক। খুলনার তিন উপজেলায় এই তহবিলের টাকায় লাগানো হয়েছে সৌর বাতি। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট লবণাক্ত পানির কারণে ফসলি জমি নষ্ট হওয়ার কোনো প্রতিকার হচ্ছে না উপকূল অঞ্চলে।
জলবায়ু ও পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে দেশে পরিকল্পনামাফিক কোনো কাজ হয়নি। এর কোনো চেষ্টাও হয়নি বিগত সময়ে। আর যখন জলবায়ু তহবিল তৈরি করা হয়, তখন তার জন্য জাতীয় প্রয়োজনে কোনো নীতিমালা বা নির্দেশনাও তৈরি করা হয়নি সেভাবে। তহবিল গঠনের পর খেয়ালখুশি মতো অর্থ খরচ করা হয়েছে, নেয়া হয়েছে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প।
জলবায়ু তহবিলের অর্থ কোথায় খরচ হবে তা ২০০৯ সালে করা জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনায় (বিসিসিএসএপি) উল্লেখ আছে। সেখানে অভিযোজনের পাঁচটি খাত অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। খাতগুলো হলো খাদ্যনিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য, সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, গবেষণা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি। কম গুরুত্ব দেয়া হয় কার্বন নিঃসরণ কমানোসহ প্রশমনে, অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন কমানোর কাজে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় অভিযোজন বলতে বাঁধ নির্মাণ, সুপেয় পানি সরবরাহ, লবণসহিষ্ণু ফসলের বীজ উৎপাদন, ভাসমান সবজি চাষের মতো প্রকল্প এবং প্রশমন বলতে সড়কবাতি, রেস্ট হাউজ, নর্দমা নির্মাণের মতো প্রকল্পকে বোঝানো হয়। তবে প্রশমনকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ বিগত সময়ে প্রশমনকেই প্রকল্পের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
বোর্ডের সদস্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সড়কবাতি বসানো ও নর্দমা নির্মাণের কোনো সম্পর্ক নেই। বিগত পাঁচ বছরে সড়কবাতি ও নর্দমার বহু প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যা অনুমোদন করাই উচিত হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু তহবিলের টাকায় ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩২২টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০৯টি সড়কবাতি বসানোর প্রকল্প, যা মোট প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ ৩৩৮ কোটি টাকা। ২৩টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে নর্দমা নির্মাণের জন্য। এতে ব্যয় ৪১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ট্রাস্টি বোর্ডের একটি সভা হয়। এতে ৬৯টি প্রকল্প অনুমোদন পায়, যার মধ্যে ৫৭টি ছিল সড়কবাতির।
জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনা এবং মুখ দেখে দেখে এসব প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এ নিয়ে অবৈধ লেনদেন হয়েছে বিভিন্নভাবে।
গত বছরের ১৮ জুন সংসদে জানানো হয়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে এই সময় পর্যন্ত সর্বমোট তিন হাজার ৮৫২ কোটি টাকা জলবায়ু তহবিলে বরাদ্দ করা হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে ৮৫০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এক গবেষণায় বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে তখন দেশে জলবায়ু খাতে কোনো ঋণ ছিল না। গত ১৫ বছরে এ খাতে জনপ্রতি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬১ ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯ হাজার ৪৮৫ টাকা। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ১৪.৪৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে, যা মোট ঋণের ৯.৭ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির শিকার শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। অলাভজনক সংস্থা জার্মান ওয়াচের ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার ১০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সাত নম্বরে।
২০২০ সালের নভেম্বরে সাতটি প্রকল্প নিয়ে এক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি জানায়, ওই সাত প্রকল্পের অর্থের ৫৪ শতাংশের বেশি অর্থ আত্মসাৎ ও অপচয় হয়েছে। সাতটি প্রকল্পই রাজনৈতিক সুপারিশের ভিত্তিতে অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্প অনুমোদনে তৎকালীন একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীকে ১০ শতাংশ অর্থ অগ্রিম ঘুষ দেয়ার অভিযোগ ওঠে।
জলবায়ুর ৮৭৪ কোটি টাকা পুনরুদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে সরকার : জানা যায়, ২০১৫ সালে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায় এক বছর মেয়াদে জলবায়ু তহবিলের ৫০৮ কোটি টাকা এফডিআর করা হয়। পরবর্তীতে ফারমার্স ব্যাংক পদ্মা ব্যাংক নামে পরিবর্তিত হয়। এফডিআর-এর মেয়াদ শেষে সুদ-আসল পরিশোধ না করায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটি নবায়ন করা হয়। ঐ সময় পর্যন্ত কয়েক দফায় পদ্মা ব্যাংক মাত্র ৮০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। তারপর এফডিআর আর নবায়ন করা হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পদ্মা ব্যাংকের কাছে আটকে থাকা ৮৭৪ কোটি টাকা জলবায়ু তহবিল মূলধন এবং সুদসহ পুনরুদ্ধারের উপায় খুঁজছে।
বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, পদ্মা ব্যাংকের অবস্থা যদিও ভালো না, তবুও আমাদের পাওনা অর্থ উদ্ধার করতে হবে। সরকার কিভাবে এই অর্থ আদায় করবে, সে বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে।
পদ্মা ব্যাংকে জলবায়ু ফান্ডের টাকা বছরের পর বছর আটকে থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নয়া দিগন্তকে বলেন, এটা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা মিটিং হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন না হলে তো টাকা চাইলেও আমি পাব না। আর মামলা করেও লাভ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংককেই পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। ওইটুকু সময় আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি নয়া দিগন্তকে জানান, জলবায়ু পুরনো ফান্ডগুলোর ব্যাপারে আমরা এখনো তদন্তের কাজ শুরু করিনি। আমরা নতুন করে একটা নীতিমালা করে দিয়েছি। সেই নীতিমালার অধীনে এবার ৭টি প্রকল্পকে ফান্ড দেয়া হয়েছে। সবগুলোই সরকারি প্রকল্পে।
বিগত সরকারের আমলে জলবায়ু ফান্ডের অনিয়মের তদন্ত করা হবে কি না- জানতে চাইলে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, তদন্ত করবো, এমন একটা প্রাথমিক সিদ্ধান্ত আছে। শিগগিরই তদন্ত শুরু করবো আমরা।