জলবায়ু ক্ষতিপূরণের অর্থের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি
- শাহ আলম আজারবাইজান থেকে
- ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৯
জলবায়ু তহবিলে অর্থ ছাড়ের বিষয়ে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর দর-কষাকষির পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবে ক্ষতিপূরণ বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে ক্ষতিপূরণ আদায়ের এই পথকে বেশ জটিল ও কঠিন মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে অর্থ ছাড় বা ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বিগত বছরগুলোতে উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করেনি। ফলে এবারের কপ-২৯ সম্মেলনে এ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। জলবায়ুুর প্রভাব মোকাবেলায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার সবুজ শিল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন কপে অংশ নেয়া ব্যবসায়িক নেতা, ব্যাংক ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘কপ-২৯ এর শেষ দিনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি সম্মেলনে কোনো কার্যকর চুক্তি না হয়, তবে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার সম্ভাবনা আরো কঠিন হয়ে উঠবে। সম্মেলনে লবিস্টদের সক্রিয় উপস্থিতি জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এতে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে যাওয়ার পরিবর্তে তাকে শক্তিশালী করছে, যা বিশ্ব জলবায়ু সঙ্কট সমাধানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে, নবায়নযোগ্য শক্তির উত্থান এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধিই একমাত্র জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলার মূল চাবিকাঠি হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অনুদান প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য করতে হবে। জলবায়ু সহায়তার ব্যর্থতা অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। আমি আশা করছি, দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্যে কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করবে। এই সম্মেলনের সাফল্য শুধু বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলাই নয়, ভবিষ্যতের জলবায়ু নীতির দিক-নির্দেশনাও নির্ধারণ করবে।
এ দিকে বাংলাদেশকে আরও জলবিদ্যুৎ দিতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে নেপাল। বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে বৈঠকে নেপালের পরিবেশমন্ত্রী আই বাহাদুর শাহী ঠাকুরি দেশটির এই আগ্রহের কথা জানান। গতকাল আজারবাইজানের বাকুতে চলমান বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে নেপালের পরিবেশমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর উপদেষ্টা রিজওয়ানা এ কথা বলেন। পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, নেপাল বাংলাদেশকে আরও জলবিদ্যুৎ দিতে আগ্রহী। এই প্রক্রিয়ার জন্য বাংলাদেশ ভুটান, নেপাল ও ভারতের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে। উপদেষ্টা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা নিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে জানুয়ারিতে। বৈঠকে অংশ নেবে নেপাল, ভূটান ও বাংলাদেশ। এটি কোথায় হবে তা এখনো ঠিক হয়নি। ওই বৈঠকে আলোচনা হবে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলার প্রশমন, অভিযোজন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে।
এ ছাড়া লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে এক হয়ে কাজ করার ওপর জোর দেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ছোট দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা সক্ষমতা অনেক কম বড় দেশগুলোর চেয়ে। আর নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রায় একই। জলবায়ু পরিবর্তন কোনো সীমানা মানে না। এর প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের সবাইকে একই কাজ করতে হবে
বৈঠক শেষে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনার জন্য ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাথে একটি মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। তবে তিনি বৈঠকের স্থান উল্লেখ করেননি।
এ সময় নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশগুলোতে প্রায় একই রকম। জলবায়ু পরিবর্তন কোনো সীমানা জানে না এবং এর প্রভাব মোকাবেলায় সব দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
এ দিকে কপ-২৯ এ অনুষ্ঠিত ‘প্রাক-২০৩০ উচ্চাভিলাষ বিষয়ক বার্ষিক উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রী পর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ২০৩০ পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য পূরণে উন্নত দেশগুলোকে দ্রুত নির্গমন হ্রাসে উদ্যোগী হতে হবে এবং প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, জলবায়ুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কিভাবে প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় মোকাবেলা করছে, তা তুলে ধরে তিনি সমন্বিত বৈশ্বিক উদ্যোগের ওপর জোর দেন। তিনি উল্লেখ করেন, এই বছর দু’টি ভয়াবহ বন্যা বাংলাদেশে ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি করেছে, যা জাতীয় বাজেটের ১.৮ শতাংশের সমান। গত ১৮ মাসে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ১৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটি। এর মধ্যে ১২ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৪ শতাংশ হলেও দেশটি চরম ক্ষতির শিকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২২ শতাংশ নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ২৭ মিলিয়ন টন নির্গমন শর্তহীনভাবে এবং ৬১ মিলিয়ন টন শর্তসাপেক্ষে কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজন ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজস্ব তহবিল এবং ১৩৫ বিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক সহায়তা। জলবায়ু ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে উন্নত দেশগুলোকে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) শক্তিশালী করতে হবে, বাজার পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে এবং উচ্চমানের জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ‘ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ মূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন প্রাপ্তি’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির জন্য বৈশ্বিক কার্যকরী ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এ দিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য বাংলাদেশের জাপান ও জার্মানির কাছে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা কামনা করলেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গতকাল জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৯) এর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-আইএমএফ প্যাভিলিয়নে আয়োজিত ‘রোড টু নেট জিরো : নেভিগেটিং দ্য এনার্জি ট্রানজিশন ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক এক সাইড ইভেন্টে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে মোট জ্বালানি ব্যবহারের ৪০% নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। চীনকে বাংলাদেশে সোলার ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট স্থানান্তরের অনুরোধ জানানো হয়েছে, যা আমদানি নির্ভরতা কমাবে। এ ছাড়া, সোলার প্যানেলের উপর কর হ্রাসসহ সংশ্লিষ্ট নীতিমালা পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে।
জাতিসঙ্ঘের আরেকটি আয়োজনে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আপডেটেড এনডিসি বাস্তবায়নে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন, যার মধ্যে ৩২ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ নিজস্ব উদ্যোগে অর্জন করবে। তবে, বাকি অংশ আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তিনি জানান, বাংলাদেশ আগামী বছর এনডিসি ৩.০ জমা দেয়ার পরিকল্পনা করছে। তিনি আরও বলেন, জিরো নেট কার্বন নিঃসরণ, দারিদ্র্যমুক্তি ও কর্মসংস্থান তৈরির ‘থ্রি জিরোস’ ভিশন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ বিশ্ব নেতাদের সহযোগিতা কামনা করছে। পাশাপাশি, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বাংলাদেশের নদীগুলো পরিষ্কারে জার্মানির সহায়তা চান।
পরে, রিজওয়ানা হাসান জাপানের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ‘আর্টিকেল ৬ ইমপ্লিমেন্টেশন পার্টনারশিপ’ সেশনে অংশ নেন। তিনি জাপানের কাছে সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা