অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন প্রত্যাশা পূরণ কতটুকু
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পর শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। সেই প্রত্যাশা পূরণে সরকারের পক্ষ থেকেও আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতি, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। এই প্রতিশ্রুতির কতটা পূরণ হয়েছে আর কতটা পূরণ হয়নি তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় মানুষ খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারছে। সমালোচনাও করতে পারছে। একই কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষের প্রত্যাশার আংশিক পূরণ হলেও সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন অটুট রয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে নয়া দিগন্তকে বলেন, এ সরকারের বড় সাফল্য বড় ধরনের কোনো দুর্নীতি হয়নি। অর্থনৈতিক মন্দা দীর্ঘদিনের অব্যবস্থার কারণেই হয়েছে। এটা কাটতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। সামাজিক চাহিদার মতো ছোটখাটো বিষয়ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। মনে রাখতে হবে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সারা জাতির মনে যে বিপুল আশা আকাক্সক্ষার সৃষ্টি হয়েছে তার সবটাই সরকারের একার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। সরকার একটা ক্ষুদ্র অংশ। অরাজনৈতিক এ সরকারের সীমাবদ্ধতা আছে; এটা স্বীকার করতে হবে। সরকারের ওপর মানুষের যাবতীয় চাহিদা বাড়লে অনেকে অধৈর্য হয়ে পড়বেন। তখন এটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এ সরকারের কোনো রাজনৈতিক দল নেই, রাজনৈতিক পরিচয় নেই। কিন্তু অরাজনৈতিক হয়েও রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি অন্তর্বর্তী সরকারকে বুঝতে হবে। নানা ধরনের রাজনৈতিক উপসর্গ সামাল দিতে হবে। অধৈর্য হলে চলবে না। সরকারের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই, আছে জনসমর্থন। তাই জনসম্পৃক্ত কাজ বেশি করতে হবে। এতে সরকারের শক্তি আরো বাড়বে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের জনসংযোগ দুর্বল। সরকার অনেক ইতিবাচক কাজ করছে যা সাধারণ মানুষকে ভালোভাবে জানাতে হবে। সরকার কী কী কাজ কেন করছে, কাজ কী হচ্ছে, তা সাধারণ মানুষ জানতে পারছে না। এই সরকার বহির্বিশ্বে বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। কিছুদিন আগে মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে জানতে পারলাম ২২ হাজার পাসপোর্ট এখনো এমআরপি করা হয়নি। এসব কাজ কিন্তু সেখানকার বাংলাদেশী দূতাবাসকেই করতে হবে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, শুধু এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেয়া যেতে পারে। কেউ মারা গেলে তার নাম এনআইডি থেকে বাদ দিতে হবে। এজন্য নতুন করে ভোটার লিস্ট করার প্রয়োজন নেই। একই সাথে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে আগাম ভোট দেয়ার ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনকে করতে হবে।
এদিকে সাধারণ মানুষ বাজারে গেলেই টের পাচ্ছে লাগামছাড়া দ্রব্যমূল্যের। সরকারের তরফ থেকে শুল্ক হ্রাসসহ আমদানির ব্যবস্থা করা হলেও বাজারে এর সুফল মেলেনি। ডিম, পেঁয়াজ, এমনকি কাঁচামরিচ পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে সঙ্কট মোকাবেলায়। কিন্তু সিন্ডিকেট বা পণ্যের হাতবদল কয়েক স্তর হয়ে ক্রেতার নাগালে পৌঁছানোর আগে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে ঠিকই ভোগাচ্ছে। টিসিবির গাড়িতে ক্রেতাদের ভিড় বাড়লেও ন্যায্যমূল্যের পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে সরকারের এক শ’ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও প্রতিশ্রুতির মধ্যে অনেকগুলোতেই তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না, যা নিয়ে সাধারণ মানুষ হতাশ।
উপদেষ্টারা বলছেন, একের পর এক আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যেও তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফল আগামী তিন মাসের মধ্যেই পুরোপুরি টের পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার মেয়াদ আরো ৬০ দিন বাড়ানো হয়েছে। যুক্ত করা হয়েছে কোস্টগার্ড ও বিজিবিকে।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের ওপর নির্বাচনী রোডম্যাপ দেয়ার জন্য চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের পর নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার অবস্থানে অনঢ় আছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য জরুরি। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণেও প্রতিবার রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘জনস্বার্থের বিপরীতমুখী এক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে। আমরা এখান থেকেই বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই; যেন এ দেশে জনগণই সত্যিকার অর্থে সব ক্ষমতার উৎস হয়।’
একই সাথে সরকার উপদেষ্টার সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। এ নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যারা এর সমালোচনা করছেন; তাদের বক্তব্য হচ্ছে ফ্যাসিস্ট শক্তি বা শেখ হাসিনার প্রতি বিভিন্ন সময়ে যারা নৈতিক ও মানসিক সমর্থন দিয়ে গেছেন তাদের অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টার ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ নেই। কোনো কোনো উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি পর্যন্ত উঠেছে।
এদিকে গণ-অভ্যুত্থানের এক মাসের মাথায় সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কারে যে ছয়টি আলাদা কমিশন গঠন করে সেগুলোর অগ্রগতি কী তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীতে এই তালিকায় নতুন আরো চারটি কমিশন যুক্ত করা হয়। আগামী ডিসেম্বরের শেষে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে চূড়ান্ত সংস্কারকাজ শুরু করা হবে বলে জানিয়েছে সরকার। কিন্তু এর কোনো সুস্পষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করা হয়নি।
তবে বিশ্লেষকরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের গতি আরো দ্রুত করার তাগিদ দিচ্ছেন। তারা রাষ্ট্র সংস্কারে কমিশন গঠনকে ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ হিসেবেই দেখছেন। তারপরও তারা চান সরকার আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করুক। এতে সরকারের সার্বিক সংস্কারকাজ গতি পাবে বলে তাদের ধারণা।
তবে সাধারণ মানুষ চায় সরকার বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে কার্যকর আরো কিছু পদক্ষেপ নিক। কারণ জিনিসপত্রের দাম আরো বেড়ে গেছে। নি¤œবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত সবাইকে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও বাজার খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছিল। নতুন সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর সুদের হার বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে টাকা না ছাপিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে সরকার। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাজারে সেটার প্রভাব খুব একটা পড়েনি। তেল, চিনিসহ আমদানি করা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়নি।
তবে আশার কথা যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। গত তিন মাসে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২০ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। ব্যাংক খাত সংস্কার ও অনিয়ম-দুর্নীতিরোধে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। সেইসাথে খেলাপি ঋণ ও বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিচ্ছে না। তবে অন্য সবল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দুর্বল ব্যাংককে সহায়তা করতে সম্প্রতি পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আগস্টের ৫ তারিখের পর মাঠে পুলিশের অনুপস্থিতি ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে অপরাধীরা। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সেভাবে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি। জনরোষের শিকার পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাগুলোর সবক’টি এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ছাত্র আন্দোলন দমনে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে পুলিশ বাহিনী যে ভাবমূর্তির সঙ্কটে পড়েছিল, সেটিও কাটিয়ে ওঠা যায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে তিন সপ্তাহে সাড়ে আট শ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই মারা গেছেন গুলিতে। ‘গণহত্যার’ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। শেখ হাসিনাসহ ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ, তাদের জোটসঙ্গীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতারে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে সম্প্রতি অনুরোধও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা