১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাজনৈতিক মাফিয়ারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে

-

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
- শেখ হাসিনাসহ অন্যদের দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের কার্যক্রম শুরু
- দেশজুড়ে মামলা প্রায় ২৫০০
- অক্টোবরেই গ্রেফতার ৬ হাজারের বেশি
- গুরুত্বপূর্ণ মামলা তদন্তে সিআইডি ও পিবিআই

গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পতনের পর কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি ও পদস্থ নেতা গ্রেফতার হলেও দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির নেতারা এখনো পলাতক। গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট সারা দেশে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও হামলার ঘটনায় হত্যা ও হত্যাচেষ্টাসহ প্রায় আড়াই হাজার মামলা রুজু হয়েছে। ওই সব মামলায় এখন পর্যন্ত পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর অভিযানে গত অক্টোবর মাসে গ্রেফতার হয়েছেন ছয় হাজারের বেশি আসামি। তার মধ্যে পুলিশের হাতে ছয় হাজার ও র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে প্রায় ২০০ নেতাকর্মী। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হলেও গণহত্যার অভিযোগে করা মামলার মূল পরিকল্পনাকারী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্য, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ আরো ডজন খানেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগস্টের পর অনেক মন্ত্রী ও এমপি সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গেছেন। তবে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে ইন্টারপোল বাংলাদেশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো অব বাংলাদেশ (এনসিবি)।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর নয়া দিগন্তকে বলেন, যারা বিদেশে পালিয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এরই মধ্যে অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে পাঠানো রিপোর্ট হাতে পেয়েছে পুলিশ সদর দফতর। ইন্টারপোলের মাধ্যমে আসামি আনার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু করেছে পুলিশ সদর দফতর।
এখনো রাজনৈতিক মাফিয়া যারা গ্রেফতার হয়নি তাদের অবস্থান কি দেশে, নাকি বিদেশে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কিছুদিন মনোবলহারা অবস্থায় ছিল। ওই সময় কেউ কেউ পালিয়ে যেতে পারেন। বর্তমানে পুলিশ বাহিনী ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন তারা ব্যাপক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা বা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এই গ্রেফতার থেকে বাদ যাচ্ছে না সাবেক মন্ত্রী-এমপিরাও। গণহত্যার সাথে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির মাধ্যমে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের ফেরত আনবে সরকার।
গত রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, পলাতক ফ্যাসিস্ট চক্র পৃথিবীর যে দেশেই থাকুক, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। গত মাসে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের গ্রেফতার করে আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার মো: আজাদ রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, গণহত্যা মামলার ৪৭টির তদন্ত পেয়েছে সিআইডি। তিনি বলেন, আমরা মামলাগুলো নিয়ে তদন্ত ভাগ করে দিয়েছি। মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হলে চার্জশিটও দিবে সিআইডি।
পুলিশ সদর দফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গণহত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫০০। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে কয়েক লাখ। তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রী, আমলা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং পুলিশসহ প্রায় ১০ হাজার আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে।
ওই সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া হত্যাসহ গুরুতর অভিযোগের ৮৭টি মামলার মধ্যে পিবিআইকে ৪০টি ও সিআইডিকে ৪৭টি মামলা তদন্তের জন্য দেয়া হয়েছে। এ দু’টি ইউনিটে এরই মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আবু ইউছুফ নয়া দিগন্তকে বলেন, ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া ওই সময়ের (বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন) ৪০টি মামলা তদন্তের জন্য পিবিআই দায়িত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরের বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের হওয়া ওই জাতীয় আরো কিছু মামলা পিবিআইয়ের কাছে এসেছে। পিবিআই সর্বোচ্চ পেশাদারত্বের সাথে মামলাগুলোর তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, গত ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে মো: নাসির, ৩ সেপ্টেম্বর বেনাপোল হতে মোহাম্মদপুর ঢাকা ছাত্রলীগ সভাপতি নাইমুল হাসান রাসেল এবং ১২ সেপ্টেম্বর কল্যাণপুর এলাকা থেকে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খাইরুল কবির খোকনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া নোয়াখালী হতে সোলায়মান বাদশা, আদাবর থেকে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মোশারফ হোসেন, ময়মনসিংহ মহানগর ছাত্রলীগের আহবায়ক নওশেল আহমেদ অনি এবং বাড্ডা এলাকা থেকে ফেনী ছাত্রলীগ পৌর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওসমান গনি লিটনসহ ১৯ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

ওই সূত্র আরো জানায়, স্বর্ণ দোকানের শ্রমিক মুসলিম উদ্দিন মিলন হত্যামামলার আসামি সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে, পাবনার ঈশ্বরদী হতে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর পুত্র শিরহান শরিফ তমালকে, রাজধানীর নিকুঞ্জ হতে সাবেক সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলাম সুজন, মগবাজার হতে সাবেক নৌমন্ত্রী শাহজাহান খানের এপিএস মো: জাহাঙ্গীর জমাদ্দারকে গ্রেফতার করা হয়।
এ ছাড়াও যশোর আরাপপুর বাসস্ট্যান্ড হতে ঝিনাইদহ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নায়েব মালী জোয়ারদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানা এলাকা হতে সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, রাজধানীর ইস্কাটন এলাকা হতে সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, আদাবর হতে সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মো: এনামুল হক, বারিধারা হতে সাবেক এমপি ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, গুলশান হতে সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, মৌলভীবাজার জেলার বর্ষিজোড়া এলাকা হতে সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরি ও তার স্বামী লাবু তালুকদার, মিরপুর থেকে কুষ্টিয়া-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রউফ, চট্টগ্রাম মহানগরীর খুলশী এলাকা থেকে নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী এবং সাভার জেলার নবীনগর থেকে ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) তাহজীব আলম সিদ্দিকীসহ মোট ৬২ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

 


আরো সংবাদ



premium cement