খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আপিল- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৯
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টের দেয়া ১০ বছরের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার করা পৃথক লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করেছেন আপিল বিভাগ। একই সাথে তার বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দেয়া ১০ বছরের সাজার রায়ের কার্যকারিতা আপিল শুনানি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আদালত। এ ছাড়া খালেদা জিয়াকে আপিলের সার সংক্ষেপ দুই সপ্তাহের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তাদের সাথে ছিলেন আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন, রুহুল কুদ্দুস কাজল, আমিনুল ইসলাম, জাকির হোসেন ভূঁইয়া, মো: মাকসুদ উল্লাহ প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান। তার সাথে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল জব্বার ভূঁইয়া, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ এস এম মোক্তার কবির খান ও সালমা সুলতানা। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আসিফ হাসান।
আদেশের পর আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক মামলা ফ্যাসিস্ট সরকার দিয়েছিল, সেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালত তাকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছিলেন। আদালতকে ব্যবহার করে ফ্যাসিস্ট সরকার পাঁচ বছরের সাজাকে ১০ বছর করেছিল। এটা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই বিরল। আমার প্রায় ৪৫ বছরের ওকালতির জীবনে এমনটা আমি কখনো দেখিনি। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে পাঁচ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর এটা আমরা কখনো দেখিনি।
খালেদা জিয়ার অন্য আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, সাজাসংক্রান্ত উভয় রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপারসনের করা লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে এই আদেশ দেয়া হয়। তিনি বলেন, আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে আপিলের ওপর শুনানি হবে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের সময় এটা ফরমায়েশি রায় ছিল। বিশেষ জজ আদালত যে রায় দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে আমরা আপিল করেছিলাম। আপিলে সাধারণত সাজা কমানো হয়; কিন্তুআপনারা দেখেছেন ফ্যাসিস্ট রেজিমের দ্বিতীয় ধাপে এসে একটা ফরমায়েশি রায় আমরা পেয়েছি। আইনবহির্ভূতভাবে পাঁচ বছরের সাজা ১০ বছর করেছে।
বহুল আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কোনো টাকা আত্মসাৎ হয়নি বলে সর্বোচ্চ আদালতকে জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী। শুনানিতে দুদকের পক্ষে আইনজীবী মো: আসিফ হাসান আদালতকে বলেন, এই ট্রাস্টের টাকা আত্মসাৎ হয়নি। জাস্ট ফান্ডটা মুভ হয়েছে। তবে সুদে-আসলে অ্যাকাউন্টেই টাকাটা জমা আছে, কোনো টাকা ব্যয় হয়নি। দুদক আইনজীবী মামলায় এজাহার, অভিযোগপত্র ও সাক্ষ্যের অংশ তুলে ধরেন। তিনি মামলার ডকুমেন্টস থেকে খালেদা জিয়া এ মামলার অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত নন এমন উপাদান পেশ করেন।
এ ছাড়া আদালতের অনুমতি নিয়ে এ মামলায় বিচারিক আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া জবানবন্দী উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের জবানবন্দী ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বেগম খালেদা জিয়ার এ জবানবন্দী তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব বহন করে। জবানবন্দীতে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিচারের প্রেক্ষাপট, হয়রানির বিষয় তুলে ধরেন। বিচার বিভাগের ওপর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণের নানা দিক তুলে ধরা হয় এ জবানবন্দীতে।
এর আগে গত ৩ নভেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের শুনানির জন্য ১০ নভেম্বর দিন ধার্য করেন চেম্বার আদালত। এরপর রোববার শুনানি শেষে আদালত সোমবার আদেশের জন্য রাখেন।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বকশীবাজারে কারা অধিদফতরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক ড. মো: আখতারুজ্জামান অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। একই সাথে খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত।
পরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া আপিল করেন। একই বছরের ২৮ মার্চ খালেদার সাজা বৃদ্ধি চেয়ে দুদকের করা আবেদনে রুল দেন হাইকোর্ট। সাজা বৃদ্ধিতে দুদকের আবেদনে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো: মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার সাজা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করেন।
এ ছাড়া পাঁচ বছরের দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে খালেদা জিয়া এবং ১০ বছরের দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে কাজী কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের আপিল খারিজ করেন আদালত।
অন্য দিকে হাইকোর্টের ওই রায়ের আগের দিন ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক মো: আখতারুজ্জামান একটি রায় দেন। রায়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। একই সাথে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। একই সাজা হয়েছে মামলার অপর তিন আসামিরও। পরে একই বছরের ১৮ নভেম্বর ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। গত ৪ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। তার অংশ হিসেবে নিজের খরচে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরির আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট সে আবেদন মঞ্জুর করেছেন। এখন পেপারবুক তৈরি হলে আপিল শুনানি হবে।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি। তবে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমার পরেও মামলা দু’টি আইনগতভাবে লড়ার কথা জানিয়ে বিএনপির আইনজীবী বলেন, বেগম খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করেছেন। সেখানে ক্ষমার কথা আছে। খালেদা জিয়া ক্ষমার প্রতি বিশ্বাসী নন। তিনি অপরাধ করেননি। তিনি ক্ষমাও চাননি। তাই এটা আইনগতভাবে মোকাবেলা করতে তিনি আইনজীবীদের বলেছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা