যে কারণে ব্যর্থ শেখ হাসিনার চায়না মডেল
দি ডিপ্লোম্যাটের বিশ্লেষণ- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৫, আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:৫৭
মার্কিন অনলাইন মিডিয়া দি ডিপ্লোম্যাটের বিশ্লেষণ হচ্ছে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার শাসনের অবসান অনেকের কাছেই বিস্ময়কর। আগের দিনও কেউ তার আসন্ন পতন অনুমান করেননি। অনেকেই মনে করেছিলেন যে হাসিনার শাসন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতেই থাকবে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক শক্তিগুলির সাথে দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তারপরেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনুমান করেছিলেন যে, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে চীনা ধাঁচের কর্তৃত্ববাদী মডেলের দিকে চলে যাচ্ছে। কারণ হাসিনার ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার কৌশল, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা এবং একটি ‘অতি প্রতিক্রিয়াশীল’ সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ, যা চীনা শাসন মডেলের কিছু দিককে প্রতিফলিত করে।
চীনের মডেল অনুকরণ করার চেষ্টা সত্ত্বেও হাসিনা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কারণে ব্যর্থ হন। প্রথমত. তার আদর্শ জনগণের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। দ্বিতীয়ত. ২০২১ থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংগ্রাম তার শাসনের বৈধতাকে ক্ষুণ্ণ করে। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের কাছে হাসিনার শাসনব্যবস্থা চীনের কর্তৃত্ববাদী মডেলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তার দীর্ঘ মেয়াদে, হাসিনা নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক ভারসাম্য ভেঙে বিচার বিভাগ, মিডিয়া ও নির্বাচন ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) মতো, তার সরকার ভিন্ন মত, প্রান্তিক বিরোধী দলগুলোকে দমন করেছিল এবং জঙ্গিবাদ, অপরাধ ও মাদক সম্পর্কিত অপরাধের প্রতি অত্যন্ত অসহিষ্ণু ছিল।
হাসিনার চীনা মডেলের অনুসরণ করার ক্ষমতা এতদূর পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে চীনের সাফল্য সিসিপির ‘ম্যাস লাইন’ মতাদর্শের গভীরে নিহিত, যা জনসাধারণের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে শাসনের ওপর জোর দেয়। এই মতাদর্শটি, প্রথমে লি লিসান প্রকাশ করার পর মাও সেতুং এতে বেশ কিছুটা পরিমার্জন করেন। তার মানে, ‘জনতার থেকে, জনসাধারণের কাছে’ নীতির ওপর কাজ করে যেখানে সরকার জনগণের দাবিগুলো বুঝতে এবং প্রতিফলিত করতে চায়। সময়ের সাথে সাথে, সিসিপি জনসংখ্যার সাথে জড়িত থাকার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করে, যেমন ২০১০-এর পতিতাবৃত্তি বিরোধী প্রচারাভিযান এবং কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর সাথে একটি দঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলে যা চীনা সমাজের মেরুদণ্ড গঠন করে।
বিপরীতে হাসিনার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল অভিজাত্যবাদী, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। তিনি যে আদর্শকে সমর্থন করেছিলেন- যাকে ‘বাঙালি-আওয়ামীবাদ’ বা ‘হাসিনাবাদ’ বলা যেতে পারে। তার মূল ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতবাদের উত্তরাধিকার, যা চারটি মূল স্তম্ভ নিয়ে গঠিত- বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র।
ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং পরবর্তী সময়ে ইসলামী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার কারণে মুজিববাদ কিছুটা হলেও ইসলামবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়। হাসিনা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ ওপর জোর দিয়ে এই আদর্শকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তার রাজনৈতিক বক্তৃতায়, এই ‘চেতনা’ একটি বিভাজনকারী হাতিয়ার হয়ে ওঠে : যারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছিল তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কার্যকরভাবে তাদের পাকিস্তান তথা ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির সাথে সংযুক্ত করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সমর্থকদের চিত্রিত করা হয়েছিল প্রকৃত বাঙালি হওয়ার সমার্থক। এটি এমন একটি কৌশল যা বিরোধীদের অমানবিক করে তোলে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই রূপ- বাঙালি-আওয়ামীজম জনসাধারণ, বিশেষ করে গ্রামীণ দরিদ্র, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সাথে এটির কোনো সম্পর্ক ছিল না। হাসিনার রাজনৈতিক মতাদর্শে তৃণমূলের সম্পৃক্ততার অভাব চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পূর্ণ বিপরীতে চিহ্নিত করেছে, যেটি কৃষক ও শ্রমিকদের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিল। এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে উঠেছিল, যে কারণে হাসিনা চীনের নেতারা যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ উপভোগ করেন তা সুসংহত করতে ব্যর্থ হন। জনসংখ্যার বিশাল অংশকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তার শাসনকে একটি অভিজাত ও বর্জনীয় আদর্শের সাথে সারিবদ্ধ করে, হাসিনা তার নিজের অজনপ্রিয়তার বীজ বপন করেছিলেন।
হাসিনার চীনের সাফল্যকে অনুকরণ করতে না পারার আরেকটি মূল কারণ হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির তীব্র পতন। হাসিনার শাসন ২০২১ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। সেই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল একটি হিসেবে প্রশংসিত করা হয়েছিল। প্রায়ই ‘এশিয়ান টাইগার’ হিসেবে উল্লেখ করা হতো। ২০২১ সালের পরে, দেশের অর্থনৈতিক ভাগ্য তীব্র মন্দা নিয়েছিল।
২০২৪ সালের জুন নাগাদ, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালে একটি শক্তিশালী ৪৮ বিলিয়ন থেকে হ্রাস পেয়ে মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায় । মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক সাধারণ নাগরিকের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। এই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণী এবং যুবকদের মধ্যে, যারা খাদ্য ও জ্বালানির ক্রমবর্ধমান দামের সাথে মানিয়ে নিতে সংগ্রাম করছিলেন। হাসিনার সরকার, যেটি একসময় তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রশংসিত হয়েছিল, হঠাৎ অর্থনৈতিক অসুবিধার জন্য নিজেকে দায়ী করা হয়েছিল।
এর বিপরীতে চীনের কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে এবং দেশটিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করেছে। সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে চীনা সরকারের সাফল্য অভ্যন্তরীণভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রদানের ক্ষমতার সাথে জড়িত। হাসিনার বেলায় উল্টোটা ঘটে। অর্থনৈতিক অবনতি সাধারণ বাংলাদেশীদের সম্মুখীন হওয়া কষ্টগুলো তার শাসনকে জনগণের কাছ থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করেছে।
চীনের বিপরীতে, যেখানে সিসিপি সামান্য সংগঠিত ধর্মীয় বিরোধিতার মুখোমুখি হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ অসংখ্য ইসলামী দল ও গোষ্ঠীর উপস্থিতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এই দলগুলো সঙ্কটের সময়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলকে একত্র করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোকে দমন করার এবং ধর্মীয় আখ্যান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাসিনার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দলগুলো প্রভাবশালী ছিল, বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুহূর্তে।
২০২৪ সালের গোড়ার দিকে চাকরির জন্য ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন যখন গতি লাভ করে, তখন তা দ্রুত সরকারি দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে বিস্তৃত প্রতিবাদে পরিণত হয়। আন্দোলনের অরাজনৈতিক প্রকৃতি প্রাথমিকভাবে এটিকে একটি নির্দিষ্ট স্তরের সুরক্ষা প্রদান করেছিল, কিন্তু ইসলামপন্থী দলগুলো তাদের সমর্থন দিতে শুরু করলে, বিক্ষোভগুলো জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশগুলোর আকর্ষণ লাভ করে। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া হাসিনার সরকার ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়।
শেষ পর্যন্ত, বাংলাদেশকে একটি চীনা ধাঁচের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে রূপান্তরের জন্য হাসিনার প্রচেষ্টা বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়। তার বাঙালি-আওয়ামীবাদের অভিজাত এবং বর্জনীয় মতাদর্শ সিসিপির গণমুখী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে চলে যায়। এই কারণগুলো ছাত্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ বৃহত্তর জনসংখ্যার সাথে মিলিত হয়ে শেষ পর্যন্ত হাসিনার পতনের দিকে পরিচালিত করে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা