২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

পুলিশি নির্যাতনে পা কেটে ফেলা ৪ শিবির নেতার অভিযোগ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিতে আসা পঙ্গু হওয়া ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতারা : নয়া দিগন্ত -


বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের আরো ৪ নেতাকে গুম করার পর গভীর রাতে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় পায়ে গুলি করে পঙ্গু করার অভিযোগে র‌্যাব-ডিবি ও পুলিশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এসে ছাত্রশিবির নেতারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে এ অভিযোগ দায়ের করেন। এ সময় তাদের সাথে ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও সহকারী আইনসম্পাদক আমানুল্লাহ আদিব।
গুম হওয়া ইসলামী ছাত্রশিবিরের চার নেতা হলেন- মো: আবুজর গিফারী, ওমর আলী, মো: রুহুল আমিন ও ইসরাফিল হোসেন। মো: আবুজর গিফারী ২০১৫ সালে গুম হওয়ার সময় জয়পুরহাট জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এবং ওমর আলী একই শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। অপর দিকে মো: রুহুল আমিন যশোর জেলা পশ্চিম চৌগাছা উপজেলা সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন এবং ইসরাফিল হোসেন একই শাখার সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

অভিযোগ দায়ের করার বিষয়ে আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসন আমলে ছাত্রশিবিরের ওপর সর্বোচ্চ বর্বরতা চালানো হয়। অভিযোগ দায়েরকারী চার শিবির নেতা এই বর্বরতার অন্যতম শিকার। পুলিশের বর্বর নির্যাতনের কারণে তাদের পা কেটে ফেলতে হয়েছে এবং কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে। একদিন রাত ৩টার দিকে আবুজর গিফারী ও ওমর আলীর পায়ে গুলি করে তাদের পা ঝাজরা করে দেয়া হয়। একইভাবে রুহুল আমিন ও ইসরাফিল হোসেনকে গভীর রাতে নির্জন স্থানে নিয়ে হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো হয় এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় তাদের দুই পায়ে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, ছাত্রশিবিরের দায়িত্ব পালন করার কারণে এই সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে। এইরকম অসংখ্য নজির ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের রয়েছে। আমরা ক্রমান্বয়ে তাদেরকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসব।
তিনি বলেন, জয়পুরহাটের ১২ জন এবং চৌগাছা থানার ৯ জন র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।

নির্যাতনের শিকার আবুজর গিফারী বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনকালে ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে। আমাদের ওপর যে অন্যায় হয়েছে, জুলুম নির্যাতন হয়েছে তার বিচার নিশ্চিত করার জন্য আমরা এখানে এসেছি। তিনি বলেন, পায়ে গুলি করার পর শুধু ড্রেসিং করা ও রক্ত দেয়ার মাধ্যমে আমাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাদের ভাইরা অনেক চেষ্টা করেছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। বারবার আবেদন করার পরও আমাদের চিকিৎসা দেয়া হয়নি। অবশেষে আমাদের পা গুলো বিনা চিকিৎসায় পচে যায়। পরে ঢাকায় আনা হলে ডাক্তার সিদ্ধান্ত দেন পা কেটে ঠেলতে হবে।
ট্রাইব্যুনালে অভিযোগে যা বলা হয়েছে : ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে, আবুজর গিফারী এবং ওমর আলী ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর জেলা শাখার বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য জয়পুরহাট থেকে হানিফ পরিবহনের বাসে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। ৯ ডিসেম্বর সকাল ৬টার দিকে আব্দুল্লাহপুর পৌঁছলে সাদা পোশাকে র‌্যাব পরিচয়ে দু’জনকেই মাইক্রোবাসে উঠিয়ে উত্তরা র‌্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পাঁচ দিন জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৫ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে তাদেরকে মাইক্রোবাসে করে হাত এবং চোখ বেঁধে রাজশাহী র‌্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ওই রাত এবং ১৬ ডিসেম্বর সারাদিন আবারো চালানো হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন। ১৬ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে রাজশাহী থেকে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচবিবি থানায় শিমুলতলী এলাকায়। সেখান থেকে তাদের সাথে বোমা ও অস্ত্র দিয়ে রাত ৪টার দিকে জয়পুরহাট র‌্যাব ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় আবারো শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন। সকাল ১০টার দিকে অস্ত্র এবং বোমাসহ সংবাদ সম্মেলন করেন জয়পুরহাট র‌্যাবের তৎকালীন মিডিয়া উইং। দুপুরে পাঁচবিবি থানার কাছে তাদেরকে অস্ত্র মামলা দিয়ে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে রাত ২টা পর্যন্ত দফায় দফায় পুলিশ নির্যাতন চালায়। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে পুলিশ তাদেরকে হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে আওলায় ইউনিয়নের একটি পরিত্যক্ত জায়গায় নিয়ে দু’জনের হাঁটুতে গুলি করে পা ঝাঁঝরা করে দেয়। তাদেরকে স্থানীয় হসপিটালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে রেফার করে দেয়। সেখানেও তাদের চিকিৎসা না দিয়ে ঢাকার পংগু হসপিটালে রেফার করে দেয়। সেখানে অপারেশন করে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রেফার করা হয়। দু’জনেরই প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় মাংস ৭৫ শতাংশ পচে যায়। ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫তে দু’জনের অনুমতি সাপেক্ষে দু’টি পা কেটে ফেলা হয়। হসপিটাল থেকে ছাড়া পেলে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ঢাকা থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদেরকে জয়পুরহাট কারাগারে পাঠানো হয়।

মো: রুহুল আমিন এবং ইসরাফিল হোসেনের গুমের ঘটনা : ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট সাংগঠনিক কাজ শেষ করে রুহুল আমিন বাড়ি যাওয়ার পথে বন্দুলিতলা শফি মল্লিকের ইটভাটার মোড় থেকে চৌগাছা থানার একজন এসআই এবং দুইজন এএসআই তাদেরকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। ৪ আগস্ট তাদেরকে ডিবি কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদেরকে আবার চৌগাছা থানায় নিয়ে আসার পথে কয়ারপাড়া এলাকায় আসলে দু’জনেরই দুই হাত পেছন নিয়ে হ্যান্ডকাপ পরানো হয় এবং চোখ বেঁধে ফেলা হয়। গভীর রাতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বন্দুলিতলার নির্জন মাঠে। সেখানে নিয়ে পুলিশ দু’জনের হাঁটুতে গুলি করে পা ঝাঁঝরা করে দেয়। আহত অবস্থায় তাদেরকে উপজেলা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে রাতেই পাঠানো হয় যশোর সদর হাসপাতালে। সেখানে দুই দিন চিকিৎসার পর কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাদেরকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ভর্তির সাত দিন পর পায়ে পচন ধরলে ডাক্তারের সিদ্ধান্তে পা কেটে ফেলা হয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করা হয় যে বন্ধুকযুদ্ধে দুই শিবির নেতা আহত। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা রুজু করে দুই মাস চিকিৎসার পর পাঠিয়ে দেয়া হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement