০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১,
`

বিসিসির প্রকল্প ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসন কারখানা

- ছবি - ইন্টারনেট

- ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতির কোম্পানি পাচ্ছে ১৪ কোটি টাকার কাজ
- সালমান এফ রহমানের ছেলে পেয়েছে ২৩ কোটি টাকার কাজ

বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) বাংলা প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক যেন ক্রমেই বাড়ছে। ডিজিটাল উদ্যোগের ছদ্মাবরণে এই প্রকল্প ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিসিসির সাম্প্রতিক টেন্ডারে ‘ড্রিম ৭১ বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামক কোম্পানিকে ১৪ কোটি টাকার কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এই কোম্পানির মালিক রাশাদ কবির পতিত আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল জব্বারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এ কাজে সোহাগের পার্টনারশিপ আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। একই প্রকল্পে ২৩ কোটি ৯৮ লাখ ৮১ হাজার ৪১০ টাকার কাজ পেয়েছে বেক্সিমকো ও তার সহপ্রতিষ্ঠান গিগাটেক। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক পতিত হাসিনা সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান এফ রহমান।
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ২০১৬ সালে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আইসিটি বিভাগ। সংক্ষেপে যা ‘বাংলা প্রজেক্ট’ নামে পরিচিত। ১৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের আওতায় ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি ডিভাইসে ব্যবহারযোগ্য ১৬টি সফটওয়্যার, টুল বা উপাদান উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় আইসিটি বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্প ২০১৯ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেয়াদ দুই দফা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে এ প্রকল্প এখন ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধযুগ পেরোতে চললেও ১৬টি টুলের মধ্যে উন্মোচিত হয়েছে মাত্র একটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রজেক্টটি গোড়া থেকেই বদিউজ্জামান সোহাগ, সালমান এফ রহমান ও আব্দুল জব্বারের ঘনিষ্ঠ লোকেরা লুটপাটের একটা ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বেক্সিমকোর প্রতিষ্ঠান গিগাটেকসহ অন্য প্রতিষ্ঠান যেমন ড্রিম ৭১ এই কোম্পানিগুলোর ভাষাভিত্তিক এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রকল্পটির দুরাবস্থা কাটছে না।

এই বাংলা প্রজেক্টেরই ‘বাংলা ভার্চুয়াল প্রাইভেট অ্যাসিস্টেন্ট’ ডেভেলপমেন্টের জন্য ড্রিম ৭১ বাংলাদেশ লিমিটেডে এর আগে পেয়েছিল ৫ কোটি ১৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকার বরাদ্দ। কিন্তু এই প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটি কাজের মান যাচাই না করেই প্রতিষ্ঠানটিকে বারবার বড় বরাদ্দ দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ড্রিম ৭১ এর ন্যায় আগেও রিভ সিস্টেমকে মোট পাঁচটি কাজ দেয়া হয় এই প্রকল্প থেকে। এই প্রকল্পে আগে ২৩ কোটি ৯৮ লাখ ৮১ হাজার ৪১০ টাকার কাজ পেয়েছে বেক্সিমকো ও তার সহপ্রতিষ্ঠান গিগাটেক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি ড্রিম ৭১ বাংলাদেশ লিমিটেডের জন্য এই বরাদ্দ প্রক্রিয়ার পেছনে প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংযোগ কাজ করছে। ড্রিম ৭১ কোম্পানিটি প্রকল্পের কাজ পেতে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল এবং রহস্যজনকভাবে ফ্যাসিস্ট যুগের আমলাদের সহোযোগিতায় এখনো সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে।
বাংলা প্রকল্পের ‘মেশিন ট্রান্সলেটর’ অংশ (এসডি-১৫) ২০২২ সালে প্রথম টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দেয়া হলে ‘রিভ সিস্টেম’ নামক একটি কোম্পানি কাজটি পায়। তবে পরে আদালতে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় সেই বরাদ্দ বাতিল হয়। এরপর ২০২৩ সালের টেন্ডারে যোগ্য প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও ড্রিম ৭১-এর পক্ষে কাজ বরাদ্দের প্রচেষ্টা চলে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক মাহবুব করিম নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলা প্রকল্পের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণের কাজ চলছে এবং বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও ব্যবহারে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। তবে প্রকল্পের কাজে ড্রিম ৭১-এর বিতর্কিত সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। ড্রিম ৭১ একই প্রজেক্টের আরো দুটি কম্পোনেন্টের কাজ, যার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা নিয়েও কাজ ছিল। এগুলো এখনো কেন শেষ হয়নি এর জবাবে মাহবুব করিম বলেন, আর কিছুদিন সময় লাগবে। তিনি ফোনে আমতা আমতা করে বলেন, রাশেদ ও সোহাগের সংশ্লিষ্টতা তার জানা ছিল না। তবে তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করার বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি। এদিকে রাশাদ আমান বলেন, তিনি বদিউজ্জামান সোহাগকে চিনতেন। কিন্তু উনি ব্যবসায়িক পার্টনার না, এগুলো গুজব। এই অবস্থায় ভার্চুয়াল ভাষা বিষেশজ্ঞরা বলেন, বাংলা প্রকল্পের কাজগুলোয় স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন, যেন প্রকৃতভাবে ভার্চুয়াল জগতে বাংলা ভাষার উন্নয়নে প্রকল্পটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এ ধরনের কাজ হতে ফ্যাসিস্ট শক্তির সব ধরনের সংশ্লিষ্টতা কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ল্যাঙ্গুয়েজ সফটওয়্যার এক্সপার্ট আনোয়ার সাঈদ নয়া দিগন্তকে বলেন, সম্পূর্ণ প্রকল্পটি এখন রিভিউ করা দরকার। ভাষা হলো ফ্যাসিজমের বয়ান তৈরির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই ফ্যাসিস্ট রেজিম বাংলায়নের নামে কী কী ফ্যাসিস্ট উপাদান বাংলা কম্পিউটার অভিধানে অভিযোজনের চেষ্টা করছে এটা জানা দরকার। তার আগে এসবে অর্থ দেয়া বন্ধ করতে হবে। আর প্রকল্পের প্রধানকে দ্রুত বিচারের আওয়াতায় আনতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement