২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১, ২৫ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

পাচারের অর্থ ফেরাতে কাজ শুরু

শেখ হাসিনার সহযোগীরা সরিয়েছেন ১৭ বিলিয়ন ডলার : গভর্নর
-

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা দেশ থেকে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার সরিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। তিনি জানিয়েছেন, এর মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারই সরিয়েছেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম। প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আহসান মনসুর এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেছেন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতরের সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করতে সহায়তা করেছেন।

এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, কোন কোন দেশে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্যের সন্ধানে জোরেশোরে কাজ করছে বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা- বিএফআইইউ, এ লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্সসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। ইতোমধ্যে এস আলম, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান, সামিট গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপসহ অগ্রাধিকারভিত্তিতে ১০টি গ্রুপের বিরুদ্ধে কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সাইফুজ্জামানের দেশে-বিদেশে থাকা সব সম্পদ বাজেয়াপ্তের জন্য উচ্চ আদালত থেকে অর্ডার দেয়া হয়েছে। এস আলমের দেশে-বিদেশে থাকা সব সম্পদ বাজেয়াপ্তের আদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হচ্ছে। এভাবে ওই ১০টি গ্রুপের সম্পদ বাজেয়াপ্তের আদেশ চাওয়া হবে। উচ্চ আদালত থেকে আদেশ পাওয়ার পর সুনির্দিষ্ট দেশগুলো থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে ফার্ম নিয়োগ দেয়া হবে। ওই ফার্মের কাছে স্থানীয় আদালতের আদেশ পাঠানো হবে।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর জানিয়েছেন, যেকোনো বৈশ্বিক মানদণ্ডে এটি সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ব্যাপক ব্যাংক ডাকাতি। এই মাত্রায় (ব্যাংক ডাকাতি) অন্য কোথাও হয়নি। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট। গোয়েন্দা সংস্থার সাথে জড়িতরা (ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহীদের) মাথায় বন্দুক না ঠেকালে এটা হতে পারত না। তিনি বলেন, ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় কয়েকটি ব্যাংক দখল করার পর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা ‘অন্তত’ ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ‘বের করে নিয়েছেন’। তার মতে, ‘তারা প্রতিদিনই নিজেদের জন্য ঋণ অনুমোদন করেছেন।’ ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর মন্তব্যের জন্য তাদের অনুরোধে সাড়া দেয়নি এবং ডিজিএফআইয়ের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গভর্নর বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন কিছু সদস্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ‘তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসে’ এবং এরপর হোটেলের মতো জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর ‘অস্ত্রের মুখে’ তাদের শেয়ার ‘মি. এস আলমের কাছে’ বিক্রির জন্য এবং তাদেরকে পরিচালকের পদ ছাড়তে বলেন। তার কথায়, ‘একের পর এক ব্যাংকের ক্ষেত্রে তারা এটা করেছে।’

একটি ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, জোর করে ব্যাংক দখলের প্রক্রিয়ায় তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ২০১৩ সালে ‘তৎকালীন সরকারের সাথে জড়িত লোকেরা’ তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পরামর্শ মতো পরিচালক নিয়োগ এবং ব্যাংকের একজন বিদেশী পরিচালকের হোটেল রুমে ‘সরকারি সংস্থার সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের’ দ্বারা তল্লাশি চালানো। মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, ২০১৭ সালে তিনি যখন ব্যাংকের পর্ষদ সভায় যাচ্ছিলেন, তখন তাকে একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এরপর পুরো একটি দিন আটকে রেখে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তিনি আরো বলেন, ‘তারা ব্যাংকের জাল কাগজপত্র তৈরি করেছিলেন। আমাকে শেষ পর্যন্ত একটি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালের পর এস আলম গ্রুপ একের পর এক ব্যাংক দখল করতে থাকে। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো দখল করা হয়। এরপর পানির মতো এসব ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিতে থাকে। পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম প্রধান অর্থের জোগানদাতা এস আলম শুধু দেশের শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোকেই দখল করে। এসব ব্যাংক খুব ভালো চলছিল। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ বিশ্বের এক হাজার ব্যাংকের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। দেশের নিচের সারির প্রায় দুই ডজন ব্যাংকের সমান এই ব্যাংকটির লেনদেন ছিল। অথচ এমনই একটি স্বনামধন্য ব্যাংক দখল করার পর রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে বিনা বাধায় এ ব্যাংক থেকে টাকা বের করতে থাকে। তার এ কাজে যারাই বিরোধিতা করেছিলেন তাদেরকেই চাকরিচ্যুত করা হয়। এজন্য ব্যাংকে একটি নিজস্ব বলয় তৈরি করা হয়েছিল। যার নেতৃত্বে ছিল এস আলমের পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন, জে কিউ এম হাবিবুল্লাহসহ প্রায় ডজনখানেক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকে একাধিক টিম পাঠিয়েছে তদন্ত করতে। এস আলম ঠিক কত টাকা বের করে নিয়েছে, কিভাবে নিয়েছে ও তার প্রধানসহযোগী কারা ছিল তার তথ্য বের করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। আরো তদন্ত চলছে। বিপুল অঙ্কের অর্থ বের করে নেয়ার পর ব্যাংকটিতে অর্থের সঙ্কট চলছে। তবে, ব্যাংকটির নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আর্থিক অবস্থা ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনেকখানিই ভালো অবস্থানে চলে আসছে।

কিন্তু এস আলমের দখলে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ বের করে নেয়ার পর ওই অর্থ আর ফেরত দেয়া হচ্ছে না। অপরদিকে ন্যাশনাল ব্যাংক ও নজরুল ইসলাম মজুমদারের দখলে থাকা এক্সিম ব্যাংকেও এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে কষ্ট হচ্ছে। তবে, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের অন্য পরিচালকরা শক্ত অবস্থানে থাকায় এস আলম এই ব্যাংক থেকে তেমন কোনো অর্থ বের করতে পারেনি। ফলে ব্যাংকটি কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে দেয়ায় কিছুটা তারল্য সঙ্কটে পড়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে যেসব অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পাচার করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য বের করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের একাধিক দেশে তিন শতাধিক বাড়ি থাকার প্রমাণ মিলেছে। এস আলমের সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ১২টি দেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য মিলেছে। একইভাবে সামিট, বেক্সিমকো, নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে এসেছে। এসব অর্থ বাজেয়াপ্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ চলছে। বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ, এ লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্স, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সমন্বিতভাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যে সাইফুজ্জামানের দেশে বিদেশে থাকা অর্থ বাজেয়াপপ্ত করতে উচ্চ আদালত থেকে আদেশ দেয়া হয়েছে। এস আলমের সম্পদও বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ঘোষণা করেছেন, যারাই এস আলমসহ অর্থ পাচারকারীদের সম্পদ কিনবে বা মালিকানায় নেবে তারা নিজ দায়িত্বে কিনবেন। কারণ এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসা হবে। এরপর তা বিক্রি করে ব্যাংকের অর্থ সমন্বয় করা হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
পাচারের অর্থ ফেরাতে কাজ শুরু নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সব ধরনের সহযোগিতা করবে সৌদি সরকার আওয়ামী লীগসহ ১১টি রাজনৈতিক দল বন্ধে সারজিস-হাসনাতের রিট হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী শতাধিক অপরাধের অভিযোগ সার্কের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো ইরান সব অস্ত্র দিয়ে ইসরাইলি হামলার জবাব দেবে ২৮ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের নিকৃষ্টতম দিন : ডা: শফিক সমালোচনার মধ্যেই চট্টগ্রামে আজ শুরু দ্বিতীয় টেস্ট রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ভিডিপিতে অস্থিরতা তৈরির পাঁয়তারা চলছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম আমের বীজ সাদ্দাম-ইনানসহ ছাত্রলীগের ২২০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা

সকল