২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০ কার্তিক ১৪৩১, ২২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ডানা অতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটে সাতক্ষীরাসহ উপকূলবাসী

ভারতের উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে ‘ডানা’র আঘাত
সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ : নয়া দিগন্ত -

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ডানার শেষাংশ গতকাল শুক্রবার সকাল নাগাদ উপকূল অতিক্রম করলেও এর প্রভাব এখনো কাটেনি। সকাল থেকে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা গুলোয় থেমে থেমে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। দুপুরের দিকে একবার সূর্য উঁকি দিলেও দিনভর আর দেখা মেলেনি। সেই সাথে থামেনি বৃষ্টিপাত। এখনো আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। তবে ডানার শঙ্কা কেটে যাওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে উপকূলের মানুষের মধ্যে।
এ দিকে ঘূর্ণিঝড় ডানার আঘাতের শঙ্কায় গত তিন দিন ধরে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জের উপকূলবাসী। টানা বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ায় উপকূলের নদ-নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্বল বেড়িবাঁধ ভাঙার আতঙ্কে ছিল তারা। উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদদ্মপুকুর, কৈখালী, রমজাননগর, আটুলিয়া ও বুড়িগোয়ালিনী এবং আশাশুনির প্রতাপনগর ও বিছট এলাকার নদীর পাড়ে বসবাস করা মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সাথে রাত কাটালেও শুক্রবার সকাল থেকে জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। নদ-নদীতে জোয়ারের পানি স্বাভাবিক সময়ের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। তবে খোলপেটুয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদ কিছুটা উত্তাল দেখা গেছে। তার পরও ঘূর্ণিঝড় ডানার আঘাতের শঙ্কা কাটায় স্বস্তি ফিরেছে উপকূলের জনজীবনে। শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালী গ্রামের বাসিন্দা সোহরাব আলী বলেন, আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে বেড়িবাঁধ প্রায় বিলীন হতে চলেছে। তাই ঝড়ের কথা শুনে আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ঘূর্ণিঝড় ডানার আঘাতের শঙ্কা কেটে যাওয়ায় উপকূলীয় এলাকার জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। লোকজন ঘর ছেড়ে বাইরে বের হতে শুরু করেছে।
আশাশুনির বিছট গ্রামের রুহুল আমিন মোড়ল বলেন, বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গেছে খোলপেটুয়া নদী। নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে বিছট গ্রামের প্রায় অর্ধেক এলাকা। গৃহহারা হয়েছে ৫০ এর অধিক পরিবার। নদীভাঙনে বেড়িবাঁধ ভাঙতে ভাঙতে আমাদের ঘরের সামনে চলে এসেছে। বর্তমানে বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক। তাই কোনো ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনলে আমরা গ্রামবাসী সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। বৃহস্পতিবার সারারাত প্রায় আমরা বাঁধের ওপর কাটিয়েছি। তিনি দ্রুত বিছট গ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কারের দাবি জানান।
সাতক্ষীরা জেলা আবহাওয়া অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাবে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে দিনভর কালবৈশাখীর মতো দমকা হাওয়া ও বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত ১৭ বছরে সিডর, আইলা, আমফান ও ইয়াসের মতো অন্তত ১৪টি বড় ঝড় ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস দেখেছে সাতক্ষীরার উপকূলের সাধারণ মানুষ। একেবারে প্রকৃতির কাছে ছেড়ে দিতে হয়েছে জীবনকে। সে রকমই ডানার প্রভাবে টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে নাকাল হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের মানুষ। এই বছরের প্রথম ঝড় রিমালের ত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ। এর মধ্যে ছোট ছোট আরো দুর্যোগ লেগেই ছিল। তবে ঘূর্ণিঝড় ডানা সরাসরি সাতক্ষীরার উপকূল আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করেছে। কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। চলাচলের মাটির রাস্তাতে হাঁটাহাঁটিও অসম্ভব হয়েছে। আমন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সাতক্ষীরার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ডানার প্রভাবে টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে রবি মৌসুম তথা শীতকালীন শাকসবজি ও আমন ধানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ভারতের উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে ‘ডানা’র যে প্রভাব পড়েছে
ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’য় ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কায় ছিল ভারতে উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। এই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব দুই রাজ্যের একাধিক অঞ্চলে পড়লেও পশ্চিমবঙ্গে তেমন তাণ্ডব দেখা যায়নি। উড়িষ্যাতে তুলনামূলকভাবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হলেও হতাহতের ঘটনা এড়ানো গেছে বলে জানিয়েছে রাজ্য সরকার।
গত বৃহস্পতিবার রাতে আনুমানিক সাড়ে ১১টায় উড়িষ্যার ভেতরকণিকা এবং ধামরার মধ্যবর্তী হাবালিখাটি নেচার ক্যাম্পের কাছে ‘ল্যান্ডফল’ প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে জানায় আবহাওয়া দফতর। এই প্রক্রিয়া চলেছে সারারাত। গতকাল শুক্রবার সকালে স্থলভাগ অতিক্রম করেছে ঘূর্ণিঝড়ের ‘লেজ’ অর্থাৎ শেষ অংশ। ‘ল্যান্ডফল’ চলাকালীন উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে ঝড়ের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। তবে সকালে ‘ল্যান্ডফল’ শেষ হওয়ার পর গতি কিছুটা কমেছে। পরে উপকূল এলাকায় ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার ছিল বলে আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে।
উড়িষ্যার উপকূলবর্তী অঞ্চল বিশেষত ভদ্রক জেলার ধামরা এবং পাশের অংশে এর তাণ্ডবের প্রভাব পড়েছে। উত্তাল হয়ে উঠেছে সমুদ্র। দুর্যোগের ফলে কাঁচা বাড়ি ভেঙে গেছে, বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে গেছে, উপড়ে গেছে গাছও।
অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম, এগরা-১, খেজুরিসহ একাধিক এলাকায় এই ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা গেছে। প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগণার উপকূলবর্তী অংশেও।
পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য দুই রাজ্যেরই উপকূলবর্তী অঞ্চলে যেখানে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেশি সেখান থেকে বাসিন্দাদের কাছাকাছি ত্রাণশিবিরে সরানো হয়। মোতায়েন করা হয়েছিল বিপর্যয় মোকাবেলা বাহিনীর বিশাল দল। শুক্রবার উপদ্রুত অঞ্চলে বিপর্যয় মোকাবেলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন ত্রাণের কাজ চালাচ্ছে। তবে আশঙ্কা থাকলেও তেমন বড়সড় ক্ষয়ক্ষতির কথা এখনো জানা যায়নি।
আবহাওয়া দফতরের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল, উড়িষ্যায় ল্যান্ডফলের কারণে সেই রাজ্যেই ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। সে কথা মাথায় রেখেই বাসিন্দাদের নিকটবর্তী আশ্রয়শিবিরে পৌঁছানোর কাজ শুরু হয়েছিল। আনুমানিক ১০ লাখ মানুষকে স্থানান্তরিত করা প্রয়োজন বলে উড়িষ্যা প্রশাসন জানিয়েছিল।
তবে উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি জানিয়েছেন, জীবনহানির ঘটনা এড়ানো গেছে। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন এবং প্রস্তুতির কারণে কোনো হতাহত হয়নি। সরকারের শূন্য হতাহতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। প্রায় ছয় লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ছয় হাজার অন্তঃসত্ত্বা নারীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।’
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ১৬০০ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গও পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিল। গত বৃহস্পতিবার রাতে হাওড়ার নবান্ন ভবনের রাজ্যের সচিবালয়ে সারা রাত উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারা। নবান্নে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন জেলার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে।
রাজ্য ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা যারা গোটা রাত কাজ করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নিচু উপকূলবর্তী নিচু অংশ থেকে দুই লাখ ১৬ হাজার মানুষকে স্থানান্তরিত করেছি।’
বড়সড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি সে কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত একজনেরই মৃত্যুর খবর পেয়েছি। তিনি নিজের বাড়িতে কেবলের কাজ করছিলেন। খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’
‘ডানা’র ল্যান্ডফল
উড়িষ্যার ভেতরকণিকা এবং ধামারার মধ্যবর্তী হাবালিখাটি নেচার ক্যাম্পের কাছে স্থলভাগে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’। আবহাওয়া অফিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাত দেড়টার পর থেকে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রীয় অংশ স্থলভাগ অতিক্রম করেছে। পরে শুক্রবার সকালে ঘূর্ণিঝড়ের ‘লেজের’ অংশও স্থলভাগে ঢুকে পড়ে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল