২০ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩০, ১৬ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

পুলিশের মূর্তিমান আতঙ্ক ধনঞ্জয়ের খোঁজ মিলছে না

-


পুলিশের মূর্তিমান আতঙ্ক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা, পুলিশে বদলিবাণিজ্যের মহারাজা খ্যাত সেই যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাসের খোঁজ মিলছে না। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ধনঞ্জয় কুমার দাস আর কর্মস্থলে যাচ্ছেন না। সরকার পতনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়। কিন্তু সেখানেও তিনি যোগদান করেননি। জনশ্রুতি রয়েছে, সরকার পতনের পর পরই তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন।
২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের (পুলিশ-৪ অধিশাখা) উপসচিব (১৫০৮৯) হিসেবে যোগদান করেন ধনঞ্জয় কুমার দাস। সরকারের অনুমোদনের পর দেশজুড়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদায়ন ও বদলির অর্ডার হতো তার স্বাক্ষরে। পুলিশের সব কিছুই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ কারণে পুলিশ সদস্যদের কাছে তিনি ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। টানা প্রায় পাঁচ বছর ছিলেন এই দায়িত্বে। স্বর্ণের ডিম দেয়া হাঁসের মতো পদটিতে যোগ দিয়ে তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এই স্বল্প সময়েই তিনি হয়েছেন অঢেল অর্থসম্পদের মালিক। তবে তার এই অবৈধ আয়ের সামান্য অংশ রেখেছেন দেশে। বাকিটা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া ও ভারতে। এসব কারণে ধনঞ্জয়কে পুলিশে বদলিবাণিজ্যের ‘মহারাজা’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন ব্যাচ মেট ও অন্য পেশার বন্ধুরা।
পুলিশ বিভাগকে তোলপাড় করা এই আমলাকে নিয়ম রক্ষায় অল্প কিছু দিনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, টানা চার বছর আট মাস পর ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর ধনঞ্জয়কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে বদলি করা হয়। তবে সেই স্বর্ণের ডিমের তাড়নায় কোনো এক জাদুবলে মাত্র তিন মাসেই ২০২৩ সালের ২০ মার্চ ফিরে আসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে। এ সময় তাকে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। এই পদে থেকেও অধস্তনদের দিয়ে চালাতেন বদলিবাণিজ্য। নতুন করে ফিরে আসার পর ৫ আগস্ট পর্যন্ত অর্থাৎ আরো এক বছর চার মাস স্বর্ণের ডিম ধরার সব প্রক্রিয়া চলমান রাখেন ধনঞ্জয়। তবে ছন্দপতন হয় স্বৈরাচার সরকার পতনে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, একজন জুনিয়র আমলা হয়েও ধনঞ্জয় কুমার দাস ছিলেন অসম্ভব ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী। ছিলেন আলোচিত-সমালোচিত। পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। লেনদেনে অমিল হলেই প্রত্যাহার হতেন, পদায়িত হতেন নতুন কর্মকর্তা। অভিযোগ রয়েছে, সব কিছুই করতেন ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছত্রছায়ায়; যে কারণে প্রত্যাহার বা নতুন পদায়নের অনুমোদন নিতে ধনঞ্জয়কে খুব একটা বেগ পেতে হতো না। একাধিক সূত্র জানায়, জেলায় পুলিশ সুপার (এসপি) পদায়নে এক কোটি থেকে তিন কোটি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সিনিয়র এএসপি) ও এএসপি পদায়নে ৪০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো তাকে। এর একটা ভাগ যেত আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায়। বাকি অংশটা ধনঞ্জয়সহ পঞ্চপাণ্ডবের চারজন মিলে ভাগ করে নিতেন। তিনি পদায়নের অর্ডারে স্বাক্ষর দেয়ার বদৌলতে প্রতি মাসে ৬৪ জেলা থেকে পেতেন বিশেষ মাসোহারা। পেতেন ডিআইজিদের রেঞ্জ কার্যালয় থেকেও। এভাবেই তিনি জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন ২০০৫ সালে সহকারী কমিশনার হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা ২১তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ৩১ আগস্ট ধনঞ্জয়কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করা হয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের রেশম উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক হিসেবে। পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবমুক্ত করা হয়। কিন্তু নতুন কর্মস্থলে তিনি আর যোগদান করেননি। কোনো প্রকার ছুটি না নিয়ে ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি অনুপস্থিত রয়েছেন সরকারি চাকরিতে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর ৫ আগস্টই ঢাকায় গা-ঢাকা দেন ধনঞ্জয় কুমার দাস। তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। পালিয়ে থেকে তিনি দেশজুড়ে দাঙ্গা বাজানোর চেষ্টা করেন। অর্থায়নও করেন এই খাতে। এমন সব তথ্য রয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।
অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, দাঙ্গা বাজতে ব্যর্থ হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ধনঞ্জয়। সর্বশেষ স্বরাষ্ট্র থেকে পাট মন্ত্রণালয়ে বদলির অফিস আদেশ জারি হওয়ার পর গত ১ সেপ্টেম্বর রাতেই তার কুমিল্লা হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য সঠিক হলে তিনিই সরকারের প্রথম কোনো আমলা, যিনি অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর নতুন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে পালিয়ে গেছেন দেশ ছেড়ে।
সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের আগেও সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগ উঠেছিল ধনঞ্জয় কুমার দাসের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তার এমন অপকর্ম তুলে ধরা হয়। তিনি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ও কট্টরপন্থী, ২০২২ সালের ১০ এপ্রিলে সরকারের একটি গোপন প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে ধনঞ্জয় নিজেই মাঠে ছিলেন বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে উঠে এসেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, জননিরাপত্তা বিভাগের ধনঞ্জয় কুমার দাসের নির্ধারিত কক্ষে অবাধ যাতায়াত ছিল বিদেশী একটি গোয়েন্দা সংস্থার বাংলাদেশে কাজ করা কর্মকর্তাদের। গভীর রাত পর্যন্ত এখানে চলত দেশবিরোধী কর্মতৎপরতা! তুলে নিয়ে গুম-হত্যার ছক হতো এই কক্ষ থেকেই। পুলিশের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাও যোগ দিতেন এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে। সূত্র আরো জানায়, পুলিশে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকদের তিনি অগ্রাধিকার দিয়ে অনুমোদন নিতেন আসাদুজ্জামান খান কামালের।
স্বরাষ্ট্রে ধনঞ্জয় কুমার দাসের দেশবিরোধী তৎপরতার বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদানের আগে থেকেই তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আলোচিত ওই বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে বাংলাদেশে কাজ করতেন গোপনে। অভিযোগ রয়েছে ২০১২ সালে বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলীকে এই গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের দিয়ে তুলে নিয়ে গুম করান তিনি। সিলেটের জনপ্রিয় এই নেতাকে আর পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া ২০১৫ সালে সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সালাউদ্দিন আহমেদকেও ধনঞ্জয়ের পরিকল্পনায় তুলে নিয়ে ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। আটকের পর তাকে নিম্ন আদালতে সাজাও দেয়া হয়। তবে উচ্চ আদালত সাজা বাতিল করে মামলাটি খারিজ করে দেয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর ট্রাভেল পাস নিয়ে দেশে ফিরে আসেন সালাউদ্দিন আহমেদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ধনঞ্জয় কুমার দাস থাকতেন জগন্নাথ হলে। পদ-পদবি না থাকলেও সক্রিয় ছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। লক্ষ্মীপুরে জন্ম নেয়া এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তার অবৈধ আয়ের সামান্য অংশ রেখেছেন দেশে। বাকিটা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া ও ভারতে। দেশে রাখা সামান্য অংশে রয়েছে একাধিক বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়িসহ বিপুল সম্পদ।

 


আরো সংবাদ



premium cement
আ’লীগ ১৪ দল জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবি পুলিশের মূর্তিমান আতঙ্ক ধনঞ্জয়ের খোঁজ মিলছে না বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবার বাইরে এখনো ৪৫০ কোটি মানুষ ৭ মার্চ ও ১৫ আগস্ট জাতীয় দিবস বাতিলের মিছিলে পিটুনি যুদ্ধ বন্ধ ও সেনা প্রত্যাহার ছাড়া কোনো বন্দিমুক্তি নয় : হামাস ২৯৭ কোটি টাকার কাজ পাচ্ছে গত সরকারের আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান! তহবিল ব্যবস্থাপনায় কাহিল পুনর্গঠিত ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিএসএমএমইউতে কম টাকায় কিডনি প্রতিস্থাপন বন্ধ শিগগিরই শুরুর আশ্বাস হত্যা মামলায় কামাল আহমেদ মজুমদার ৩ দিনের রিমান্ডে জান্তা পতনে মিয়ানমারে মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান এক সাথে লড়ছে ইলেকশন কমিশন গঠনে দ্রুতই সার্চ কমিটি হবে : মাহফুজ

সকল