০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১, ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যার পানি কমলেও বাড়ছে ভাঙন

লালমনিরহাটের আদিতমারীর বিভিন্ন এলাকায় ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি : নয়া দিগন্ত -


ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় প্লাবিত নিম্নাঞ্চল ও নদ-নদী বেষ্টিত চর এলাকা থেকে বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়া অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হয়েছে। তবে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট জেলার প্রধান নদীগুলোর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাঙনের খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) কর্মকর্তারা জানান, গতকাল ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় উজান থেকে প্রবাহিত হয়ে আসা পানির হার ক্রমাগত হ্রাসের ফলে প্রধান নদ-নদীর পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে।
বাসস জানায়, গতকাল সকালে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বিডব্লিউডিবির সব মনিটরিং পয়েন্টে সবগুলো নদীর পানি নিজ নিজ বিপদ সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি অব্যাহত রয়েছে।
বিডব্লিউডিবির রংপুর জোনের প্রধান প্রকৌশলী মো: মাহবুবুর রহমান বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হতে পারে। নদী ভাঙনের ঝুঁকিপূর্ণ কিছু স্থানে অতি জরুরি ভিত্তিতে তীর রক্ষার কাজ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানির স্তর অন্তত ৩০ সেন্টিমিটার এবং নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে পানির স্তর অন্তত ১০ সেন্টিমিটার কমেছে। প্রধান প্রকৌশলী জানান, গতকাল সকাল ৯টায় তিস্তা কাউনিয়া পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার এবং ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ধরলা কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ২৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং দুধকুমার কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদ নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২৬৪ সেন্টিমিটার, হাতিয়ায় ৩০৪ সেন্টিমিটার এবং কুড়িগ্রামের চিলমারী পয়েন্টে ২৬৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যমুনার পানি ফুলছড়িতে বিপদসীমার ২৯১ সেন্টিমিটার, সাঘাটায় ২৩০ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদে ২৬২ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে ২৩৮ সেন্টিমিটার, কাজিপুরে ২৫৩ সেন্টিমিটার এবং সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ২২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
রংপুর বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনার মো: আজমল হোসেন জানান, বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হলেও ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের দুর্ভোগ লাঘবে জেলা প্রশাসন ত্রাণকার্যক্রম পরিচালনা করছে। রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলার বন্যাপ্রবণ এলাকায় বিডব্লিউডিবির কর্মকর্তা, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বন্যা ও নদীভাঙন পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। রংপুর অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মো: ওবায়দুর রহমান মণ্ডল জানান, এবার বৃহত্তর রংপুরের পাঁচটি জেলার ১৭ উপজেলায় চলতি মৌসুমের অস্থায়ী বন্যায় এক হাজার ৪৩২ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানির নিচে তলিয়ে যায়।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, তিস্তা নদীর পার্শ্ববর্তী চরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চল থেকে পানি হঠাৎ কমে যাওয়ায় জেলার কয়েকটি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। গত দুই দিনে বহু ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে কয়েক শ’ ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভাঙনের আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে নদীপাড়ের বাসিন্দাদের। আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বাহাদুরপাড়া, গরিবুল্লাপাড়া, সদরের খুনিয়াগাছ, রাজপুর, তাজপুর এলাকায় ভাঙন অব্যাহত আছে। দুই দিনে এসব এলাকায় অর্ধশতাধিক বাড়ি ভেঙে গেছে। এ ছাড়া এসব পয়েন্টে কমপক্ষে ৫০০ পরিবার ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পানি আরো কমলে ভাঙন আরো তীব্র আকার ধারণ করবে।
বাহাদুর পাড়ার রহমত উল্লাহ বলেন, এই জীবনে ১৭ বারের বেশি বাড়িঘর সরিয়েছি। আমি এই গ্রামের লাখপতি ছিলাম। কিন্তু আজ আমার কিছু নেই। নেতারা এসে তিস্তাপাড়ের মানুষকে শুধু আশ্বাস দিয়ে ভোট নেন। জানি এবারো তার ব্যতিক্রম হবে না। তাদের আশ্বাস দিয়ে আর কী হবে আমাদের জীবনে? তিস্তা নদীতে সব জমি বিলীন হয়ে গেছে। গত কয়েক দিনের তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে আমার ঘর সরাতে হয়েছে। নতুন সরকারের প্রতি অনুরোধ দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তিস্তা পাড়ের মানুষকে রক্ষা করুন।

হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মশিউর রহমান জানান, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দুই দিন এই ইউনিয়নের অনেক ঘরবাড়ি ডুবেছিল। পানি কমতে শুরু করেছে। এখন ভাঙন আতঙ্ক বাড়ছে। জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, ‘আমরা ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। বরাদ্দের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। জরুরি বরাদ্দ পেলেই ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব উদ্দীন বলেন, বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে ১৩ লাখ টাকা ও ৯০ টন জিআর চাল বিতরণ শুরু হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, জেলার ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, কালজানিসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে পানি কমার সাথে সাথে নদ-নদীতে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার কালজানি নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, কুড়িগ্রামের রাজাহাট উপজেলায় ঘড়িয়াল ডাঙ্গা ইউনিয়নের গতিয়াশাম, বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের খিতাব খাঁ, কালীঘাট, রামহরি, চতুরা, তৈয়ব খাঁ ও নাজিম খান ইউনিয়নের শ্রম নারায়ণ এলাকায় তিস্তার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া জানান, সোমবার তার ইউনিয়নের কমিউনিটি ক্লিনিক নদীতে বিলীন হয়ে যায়। দোতলাবিশিষ্ট বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র ব্রহ্মপ্ত্রু নদীতে বিলীনের পথে। এছাড়া গত চার দিনে ৮০টি পরিবারের বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভুরুঙ্গামারীর পাইকের ছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক জানান, দুধকুমার নদীর গনাইরকুটি, চরবলদিয়া, পাইকের ছড়া এলাকার তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রাকিবুল হাসান জানান, কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে উন্নতি আছে। তবে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র দুধকুমার ও কালজানি নদীর বেশ কয়টি পয়েন্টে ভাঙন চলছে। কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধের কাজ চলমান রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement