২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

তিস্তার পানি বাড়ছে ফের বন্যার আশঙ্কা

-


তিস্তার উজান ও ভাটিতে প্রবল বৃষ্টিপাতে চলতি মওসুমে ৫ম বারের মতো বাড়ছে তিস্তার পানি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেকোন মুহূর্তে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে আবারো বন্যার শঙ্কা তিস্তা অববাহিকাজুড়ে। এরই মধ্যে দুই পাড়ের চরাঞ্চল-নিম্নাঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
উত্তরাঞ্চল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তার ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। ভাটিতে রংপুরের কাউনিয়া তিস্তা সেতু পয়েন্টে মাত্র বিপদসীমার মাত্র ১ সেন্টিমিটার নিচে ছিল তিস্তার পানি। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবেছে। বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে আমনের ক্ষেতসহ আবাদি জমি। তিনি জানান, তিস্তার ভারত অংশের আশপাশে গত ২৪ ঘণ্টায় পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে ১৬৪.০, কালিম্পংয়ে ১৩০.০, দার্জেলিংয়ে ৭৭.০ এবং কুচবিহারেও ৫৪.০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ ছাড়া তিস্তার বাংলাদেশ অংশের রংপুরে ৪১.০ নীলফামারীর ডিমলায় ৭৩.০, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ৫৪.০, রাজারহাটে ২৭.মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। সে কারণে এই বন্যা। এই সময়ে আগে থেকেই তিস্তার ৪৪টি দরজা খুলে দেয়া থাকে। তিনি জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে এবং পরবর্তী ২ দিন হ্রাস পেতে পারে এবং লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা নদীর পানি সমতল বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে এবং জেলাগুলোর সংশ্লিষ্ট চরাঞ্চল-নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। পরবর্তী ২ দিনে তিস্তা নদীর পানি সমতল হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হতে পারে। অপর দিকে আগামী ৩ দিন পর্যন্ত কুড়িগ্রাম জেলার ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।

এদিকে তিস্তায় পানি বৃদ্ধির কারণে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, সদর, নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চলে পানি উঠেছে। অববাহিকার অন্তত ৩০ হাজার মানুষের বাড়িঘরে পানি উঠেছে। রান্না এবং শিশুদের নিয়ে বিপাকে পানিবন্দীরা। তলিয়ে গেছে উঠতি বাদামসহ ফসলি জমি। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিলেও এসব মানুষের পাশে এখনো পাশে দাঁড়ায়নি কেউ।
পানি বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে ভাঙন। রংপুরের গঙ্গাচড়ার মর্নেয়া, কোলকোন্দ, লক্ষিটারী, মর্নেয়া, কাউনিয়ার বালাপাড়ার গদাই, পীরগাছার ছাওলা, তাম্বুলপুর লালমনিরহাটের হাতিবান্দার সিন্দুরনা, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ি, কালিগঞ্জের কাকিনা, আদিতমারির মহিষাখোচ, সদরের খুনিয়াগাছ, কুড়িগ্রামের রাজারহাটের বিদ্যানন্দ, গতিআসাম, বুড়িরহাট, উলিপুরের ঠুটাপাইকর, থেতরাই, বজরা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তারাপুর, বেলকা, হরিপুর ইউনিয়নের অন্তত ১২৫ পয়েন্টে ধরেছে ভয়াবহ ভাঙন।

উত্তরাঞ্চল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, গুরুত্ব বিবেচনায় কিছু কিছু এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে। তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি জানান, তিস্তা উত্তরের ২ কোটি মানুষের জীবনরেখা। প্রতি বছর এখানে ২০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়। প্রায় লাখো কোটি টাকার ক্ষতি হয়। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় তৈরি হয়েছে এই অবস্থা। যেহেতু পানি চুক্তি হচ্ছে না। তাই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেই এই অবস্থার উত্তরণ সম্ভব। আমরা চাই চীন ভারত নয়, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হোক। গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাহিদ তামান্না জানান, আমরা সতর্ক অবস্থায় মাঠে আছি। এরই মধ্যে দুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে। এই সহায়তা অব্যাহত থাকবে। রংপুরের ডিসি মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল জানান, তিস্তার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে পানিবন্দী মানুষের পাশে আছে প্রশাসন। যে কোনো মোকাবেলা করতে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনকে প্রস্তুত রেখেছি। সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি আছে আমাদের।

তিস্তার পানি বাড়ছে ফের বন্যার আশঙ্কা
নীলফামারী ও লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানায়, ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢল ও তিন দিনের অবিরাম ভারী বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে তীরবর্তী বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। চরাঞ্চলগুলোর ঘরবাড়ি ও ফসলি জমিতে পানি উঠতে শুরু করেছে। নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষ বন্যা ও নদীভাঙন আতঙ্কে পড়েছেন। পানি তিস্তা নদীর বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। পানির চাপ কমাতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি কপাট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যে কোনো মুহূর্তে বিপদসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। বিপদসীমা অতিক্রম করলে পানিবন্দী হয়ে পড়বে দুই জেলার কয়েক হাজার মানুষ।
ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, গতকাল বেলা ২টা পর্যন্ত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। পানি বৃদ্ধিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় প্রায় ২ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজের পানি পরিমাপক নুরুল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।
এ দিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৮-১০টি চর ও পার্শ্ববর্তী কালীগঞ্জ, আদিতমারী উপজেলার ১০-১৫টি চর এলাকায় পানি উঠতে পারে বলে জানা গেছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, এখন পর্যন্ত তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। পানি বৃদ্ধির কারণে তিস্তার নিম্নাঞ্চলের যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে সেই সব এলাকার উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে এবং ত্রাণ ও সহযোগিতা কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিমলা উপজেলার গয়াবাড়ী, পশ্চিম ছাতনাই, পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানী ও ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের প্রায় ১০টি গ্রাম ও নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় প্রায় ২ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বেশ কিছু স্থানে তিস্তার বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

ছোটখাতা এলাকার মাজেদুল ইসলাম (২৭) বলেন, বৃষ্টির কারণে বাঁধ ধসে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বাঁধ সংস্কার না করলে ভাঙন আরো বড় আকারে রূপ নিতে পারে।
ছাতুনামা কেল্লাপাড়া গ্রামের আব্দুর রহিম (৪০) বলেন, দুপুরে বাড়ির উঠানে উঠে গেছে। আর একটু পানি বাড়লেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। ১০ নং পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: আব্দুল লতিফ খান বলেন, ঝাড় সিংহেশ্বর ও পূর্ব ছাতনাই মৌজার ৬টি ওয়ার্ডের প্রায় ১৩০০ পরিবার পানিবন্দী রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ৭ নং খালিশা চাপানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: সহিদুজ্জামান সরকার দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, বাইশ পুকুর এলাকায় প্রায় ৪ শতাধিক বাড়িঘরে পানি উঠেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement