২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান না হলে পুরো অঞ্চল সমস্যায় পড়বে

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান ড. ইউনূসের
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের সাইড ইভেন্টে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন : পিআইডি -


বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমাদের সতর্ক হতে হবে, এই সঙ্কটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে।
জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে গত মঙ্গলবার রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের এক আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো: তৌহিদ হোসেন, শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, আইসিসি প্রসিকিউটর করিম এ এ খান, আইওএম মহাপরিচালক অ্যামি পোপ প্রমুখ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, প্রথমত আমরা চাই জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সব পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুক।
সম্মেলনে সঙ্কটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনাপূর্বক নতুন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তেমন প্রস্তাব আসতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দ্বিতীয়ত জাতিসঙ্ঘ ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’ কার্যক্রমে নতুন করে প্রাণশক্তি যোগ করার প্রয়োজন। যেহেতু এখন রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করার মতো তহবিলের অভাব রয়েছে, তাই রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরো জোরদার করতে হবে।
তৃতীয় প্রস্তাবে ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আন্তরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দ্বারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো অনুষ্ঠান হচ্ছে তবে ড. ইউনুসের উপস্থিতি ও তার দৃষ্টিভঙ্গি এবারের আলোচনাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বৈষম্য, রাষ্ট্রহীনতা এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত বন্ধ করতে আমাদের অবশ্যই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

বৈঠকের পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে এবারের বৈঠকটি অত্যন্ত সফল ছিল। সবাই বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা এবং তাদের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
আইওএম মহাপরিচালক অ্যামি পোপ বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, এই সঙ্কট সমাধানে আমাদের আরো কাজ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে।
আইওএম মহাপরিচালক জানান, তারা এই লক্ষ্য অর্জনে সম্ভাব্য সবকিছু করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের এই আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশ ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ১৯ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের নতুন সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন।

এই মার্কিন সহায়তা জীবন রক্ষা বিশেষ করে সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা, আশ্রয় এবং খাদ্য সরবরাহে সহায়তা করবে।
এ দিকে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে ‘আমাদের হতাশ করবেন না’ মর্মে একটি বার্তা পাঠিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ওই ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভুলে যাওয়া যাবে না’।
বাংলাদেশ ২.০-এর জন্য সহায়তার প্রস্তাব আইএমএফ প্রধানের : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা বিষয়টি নিয়ে অংশীজনদের সাথে আলোচনা করতে ঢাকায় একটি দল পাঠিয়েছে।

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ও বাংলাদেশ সময় বুধবার জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের (ইউএনজিএ) ফাঁকে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে এক বৈঠকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার এ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
প্রধান উপদেষ্টা ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে বাংলাদেশের পূর্ববর্তী স্বৈরাশাসন উৎখাত করা ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং করেন। তখন ক্রিস্টালিনা তাকে বলেন, ‘এটি একটি ভিন্ন দেশ। এটি বাংলাদেশ ২.০।’
বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস নির্বাচন, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য তার অন্তর্বর্তী সরকার যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে সে সম্পর্কে কথা বলেন।
তিনি বলেন, কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করবে।
সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত এবং ভোটার তালিকা তৈরি হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আইএমএফের প্রধান নির্বাহী এসব উদ্যোগে তার সমর্থন জানিয়ে বলেন, আইএমএফ বাংলাদেশ সরকারের জন্য আর্থিক সহায়তা দ্রুততর করবে। তিনি বলেন, তিনি বাংলাদেশে ‘দ্রুত’ একটি আইএমএফ দল পাঠিয়েছেন এবং এই মুহূর্তে সেটি ঢাকায় অবস্থান করছে। দলটি আগামী মাসে আইএমএফ পরিচালনা পর্ষদের কাছে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জর্জিয়েভা বলেন, আইএমএফ বোর্ড টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ঋণদান কর্মসূচি শুরু করতে পারে, অথবা এটি গত বছরের শুরুর দিকে চালু হওয়া বিদ্যমান সহায়তা কর্মসূচির অধীনে আরো ঋণ দিতে পারে।
জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহন উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান আইএমএফ প্রধানকে বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র এক সপ্তাহ সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অপরাধের ‘দুর্গ’ গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় দেশের অর্থ প্রদানের ভারসাম্য বাড়াতে আইএমএফের সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে আইএমএফের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।

নির্বাচন কখন হবে, জানালেন প্রধান উপদেষ্টা : প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাধারণ নির্বাচনের তারিখ কখন ঘোষণা করা হবে সেটির একটি ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যখন সবাই একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছবে এবং ভোটার তালিকা প্রস্তুত হবে তখনই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হবে। এর আগে প্রয়োজনীয় সব সংস্কার করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সাথে বৈঠকে এমন তথ্য জানান ড. ইউনূস। তিনি আইএমএফের প্রেসিডেন্টকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের কাজ হলো নির্বাচন, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা এবং সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো খুঁজে বের করা এবং সেগুলো সরকারকে অবহিত করা।
এই কমিশনের দেয়া প্রস্তাব সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপর যখন সবাই সংস্কারগুলো নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছবে এবং ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হয়ে যাবে তখনই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রেসিডেন্ট এসব সংস্কারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারকে দেয়া আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারেন তারা। এর আগে সকাল থেকেই প্রধান উপদেষ্টা ব্যস্ত সময় পার করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠকের পাশাপাশি আরো কয়েকটি বৈঠক ও অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তিনি ভাষণ দেবেন।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে এ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়।
এ ছাড়াও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ বেশ কয়েকজন সরকারপ্রধান ও বিভিন্ন সংস্থার প্রধানের সাথে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। সংক্ষিপ্ত বৈঠকে বাংলাদেশ-কানাডা সম্পর্ক জোরদার, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন ড. ইউনূস ও জাস্টিন ট্রুডো।
ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত করমর্দন করে ড. ইউনূসকে আলিঙ্গন করে হাসিমুখে ছবি তুলছেন। এ সময় দু’জনকে খুব হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement