২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বিতর্কে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরষের মধ্যেই ভূত!

-

সরষের মধ্যেই যেন ভূত! জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একের পর এক বিতর্কিত-আলোচিত ঘটনার পর এমনটি মনে হতেই পারে। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যত্থানের পর দেশের প্রশাসন ঢেলে সাজানো যখন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নানা মহলে আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়ে চলেছে। জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়ন নিয়ে প্রথমেই তৈরি হয় লেজেগোবরে অবস্থা। তিন দফায় ৫৯ জেলায় ডিসি নিয়োগের পর সমালোচনার মুখে ৯ জেলা থেকে ডিসি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় মন্ত্রণালয়। পতিত হাসিনা সরকারের সময়ে বৈষম্যের শিকার বঞ্চিত কর্মকর্তাদের হাতে লাঞ্ছিত হন যুগ্মসচিব পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা। এই ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার আগেই আরেক কর্মকর্তার রুমে তিন কোটি টাকার চেক পাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনারও তদন্তে কমিটি গঠন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এখনো শেখ হাসিনার আস্থাভাজন কর্মকর্তারা বহাল থাকায় এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আওয়ামী সরকারের আজ্ঞাবহদের সরিয়ে ১৫ বছর ধরে বঞ্চিত মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং পদায়নের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। এরই আলোকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগের জন্য যাচাই-বাছাই শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর তিন দফায় ৫৯ জেলায় ডিসি পদায়ন করা হয়। কিন্তু দেখা যায় পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে দুই-তিনজন ছাড়া বাকি সবাই পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সুবিধাভোগী। ওই সরকারের মন্ত্রী-সচিবের পিএসসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তারা। ব্যাপক যাচাই-বাছাই করে তালিকা তৈরির পরও ডিসি পদে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা কী করে নিয়োগ পেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে জনপ্রশাসনে।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বিতর্কিত করতে এবং বেকায়দায় ফেলতে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থাকা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন কর্মকর্তারা এমন বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। আওয়ামী লীগ সরকারের একজন অতি আস্থাভাজন কর্মকর্তা মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুবুর রহমান। শেখ হাসিনার অনুগত হওয়ার কারণেই তাকে নিয়মিত চাকরির পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বিসিএস ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থাভাজন হওয়ায় প্রথমে সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিমকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা জাহাঙ্গীর আলম রয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সচিব হিসেবে। এর আগে তিনি সমাজকল্যাণ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক, নরসিংদী ও ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক এবং আইডিয়াল কলেজের ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা আবু হেনা মোরশেদ জামান আছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হিসেবে। তার মন্ত্রণালয়ে পুনর্বাসন করেছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও যশোরের ডিসি তমিজুল ইসলাম খানকে।

স্বৈরাচারী সরকারের জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি সালমা চৌধূরীর স্বামী সোলেমান খান আছেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) হিসেবে। মৌলভী বাজারের সাবেক ডিসি ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ হল সভাপতি কামরুল হাসান রয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে। ২০১৪ সালে সাতক্ষীরায় জামায়াত কর্মীদের নিপীড়নের কুশীলব নাজমুল আহসান রয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক ও রংপুরের সাবেক ডিসি, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ও সাবেক মেয়র ফজলে নুর তাপসের ঘনিষ্ঠ ফরিদ আহম্মদ রয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে।
শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস কাজী নিশাত রসুলের বোন কাজী তুহিন রসুল রয়েছেন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে। সাবেক সচিব ও গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সিরাজুন নুর চৌধুরী, দিলরুবা শাহীন, যুগ্মসচিব মেহেদী মাসুদুজ্জামান বহাল তবিয়তে থেকে অর্থ বিভাগে কোন অফিসার আসবে, কে কোথায় পদায়িত হবে তা এখনো নিয়ন্ত্রণ করছেন।

ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলমকে সরকার বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী একান্ত সচিব এ কে এম সাইফুল আলম বহাল তবিয়তে আছেন জননিরপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের পিএসের মতো সংবেদনশীল জায়গায়। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা: সারোয়ার বারী। নিজের একান্ত সচিব হিসেবেও নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাহিদ হাসানকে, যিনি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সাথে সচিবালয়ে ঘোরাঘুরি করে তার তদবির বাণিজ্যে সহায়তা করতেন। এই প্রভাব খাটিয়ে তার স্ত্রী আকতারুন্নেসাকেও পদায়ন করেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে।

স্বৈরাচার আমলের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী গ্রেফতার হলেও দিব্বি দায়িত্বে আছেন তার দশ বছর একান্ত সচিব মাশুকুর রহমান সিকদার। ওই পদে থাকাকালে বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে মন্ত্রীর সাথে ভাগাভাগি করে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নাটোরের সাবেক ডিসি, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার পরে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, এরপর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করা মশিউর রহমান রয়েছেন সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব হিসেবে। গোপালগঞ্জের সাবেক ডিসি মোখলেসুর রহমানের স্ত্রী রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যানের বোন তানজিয়া সালমা রয়েছেন ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে।

নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির পেছনে সরকারের একজন উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক আহসান কিবরিয়া সিদ্দীকীকে দায়ী করেছেন ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হলেও প্রশাসনের সর্বস্তরে ওই সরকারের সুবিধাভোগীদের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা কলকাঠি নেড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিগত সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ ওঠে ওই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে।

তিনিই যোগ্য, মেধাবী ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদানে শুরুতেই বাধা হয়ে দাঁড়ান। শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নিযুক্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীনদের সরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি ছিল তার। আওয়ামী লীগ আমলে সাজানো প্রশাসনে কোনো ধরনের পরিবর্তনে সম্মত ছিলেন না তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত নানা চাপে কয়েক দিন পর এসব পদে রদবদল আনা হয়। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনে সহায়তাকারী ইউএনও, ডিসি, এসপি ও বিভাগীয় কমিশনারসহ বিভিন্ন পদে থাকা কর্মকর্তাদের পুনরায় পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তিনি। সর্বশেষ ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তালিকায়ও সেটি ফুটে উঠেছে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
ঢাকাসহ ১২ সিটি, ৩২৩ পৌরসভার কাউন্সিলরদের অপসারণ বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতা আরো গভীর করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র তুলে নিয়ে বেঁধে মারধর, মৃত ভেবে দুই ছাত্রদল নেতাকে ফেলে গেল দুর্বৃত্তরা সাকিবের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে না বিসিবি সার্চ কমিটি থেকে বুলবুলকে অব্যহতি শান্তির জন্য জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই বন্দর দিয়ে ৬১ টন ইলিশ গেল ভারতে রাষ্ট্র সংস্কার করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সময়ের দাবি: সৈয়দ ফয়জুল করীম মোদির সাথে ট্রাম্পের সাক্ষাৎ কেন হলো না মিত্রদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, লেবাননে সর্বশক্তি দিয়ে হামলার নির্দেশ নেতানিয়াহুর গোলাপগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১

সকল