২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়া করছে না বিএনপি

প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপের আশা দলটির
-


নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে না বিএনপি। তবে দলটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে দ্রুত নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ আশা করছে। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এই সরকার জনগণের সরকার। তাদের নেয়া সংস্কার উদ্যোগেও জনগণের সম্মতি রয়েছে। তবে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ প্রতিষ্ঠাই এই সরকারের সব সংস্কারকার্যক্রমের প্রধান টার্গেট হওয়া উচিত।
গত সোমবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সব ধরনের সমর্থন দেয়ার কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি তার পাশে থাকব। যা-ই হোক না কেন। যাতে করে তিনি তার কর্মসূচি সম্পন্ন করতে পারেন।’ তার মতে, দেড় বছরের মধ্যেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ হওয়া উচিত এবং সেনাবাহিনী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। একই সাথে তার এ সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য এবং সশস্ত্রবাহিনীকে প্রেসিডেন্টের অধীনে নেয়ার ধারণা উঠে এসেছে।

তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি জোরপূর্বক শাসনের অবসানের পর সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস। তারপর থেকে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ‘যৌক্তিক’ সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে আসছে। তবে এই যৌক্তিক সময়ের কোনো সময়সীমা দলটি এখনো উল্লেখ করেনি। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এই সরকারকে ইতোমধ্যেই সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দিতে চায় না তারা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত সপ্তাহে পল্টনের সমাবেশে যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দলটির প্রত্যাশাগুলো ফুটে উঠেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারেক রহমানের ওই বক্তব্যই দলটির সর্বসম্মত অবস্থান। তারেক রহমান তার বক্তব্যে এই সরকার নিজেরাই যাতে ব্যর্থতার কারণ হয়ে না দাঁড়ায় সে ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কারকার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া উন্নয়ন-গণতন্ত্র কিংবা সংস্কার কোনোটিই টেকসই এবং কার্যকর হয় না। একটি অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিটি ভোটারের ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করে ভোটারদের কাক্সিক্ষত প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
সেনাপ্রধান আঠারো মাসের মধ্যে নির্বাচনের যে মন্তব্য করেছেন সে বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই হওয়া উচিত। তিনি বলেন, নির্বাচন যত দ্রুত হবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সংস্কারপ্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের সাথে সাথে একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রয়োজন। তাহলেই দেশের জনগণ বুঝতে পারবে দেশে চলমান সংস্কারকার্যক্রম একটি গণতান্ত্রিক পন্থায় যাচ্ছে। জনগণও গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশসহ ছয়টি বিষয়ে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। এসব কমিশনের ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি সরকারের এই সংস্কারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। জানা গেছে, বিএনপিও সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে ছয়টি কমিটি গঠন করেছে। বিষয়ভিত্তিক এই কমিটিগুলো দলের কর্মকৌশল নির্ধারণের পাশাপাশি অংশীজনের সাথে মতবিনিময় করবে। গঠিত ছয়টি কমিটি হলো- রাষ্ট্র সংস্কার, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, প্রশাসন সংস্কার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, নির্বাচন কমিশন এবং ব্যাংকিং ও বাণিজ্য। এছাড়া দুনীতি দমন কমিশন সংস্কারসহ আরো কয়েকটি কমিটি গঠনেরও চিন্তা করছে দলটি।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে বিএনপি ঘোষিত রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখায় অধিকতর যুগোপযোগী ও এর প্রচারের জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি রাষ্ট্রগঠনে ৩১ দফা প্রচার ও জনমত তৈরিতে কাজ করবে। দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মূলত সরকার গঠিত কমিটির সংস্কারের বিষয়ে দলের কৌশল তৈরি ও সে অনুসারে প্রাসঙ্গিক কাজ নির্ধারণ করতে তারা কাজ করবেন। সংস্কার নিয়ে রাজনীতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করলে বিএনপি যাতে তাদের পরামর্শ তুলে ধরতে পারে সেই প্রস্তুতিও নিবে এসব কমিটি।

স্থায়ী কমিটির বৈঠক : গত সোমবার বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানা গেছে, বৈঠকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয় বরং ক্যাম্পাসে ইতিবাচক রাজনীতির ধারা চালু করতে চায় বিএনপি। কারণ হিসেবে দলটি বলছে, দেশগঠনে ছাত্ররাজনীতির ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬২ সালের পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলনের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির বড় ভূমিকা রয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম, স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ আরো বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি অঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন স্থায়ী কমিটির নেতারা। বৈঠকে কেউ কেউ মত দেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ইন্ধনে তার দোসররা দেশে অস্থিরতা করার চেষ্টা করছে। পাহাড়ে হঠাৎ অস্থিরতা কেন হচ্ছে তার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

এর পেছনে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোর হাতে সন্ত্রাসীদের দমন করার পরামর্শ দেন কেউ কেউ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে কোনো কোনো নেতা বলেন, স্থানীয় সরকারের সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলার চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি বর্তমান সরকারের। দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই পালিয়ে বা আত্মগোপনে রয়েছে। এতে ইউনিয়ন পরিষদে নাগরিক সেবা পেতে গেলে জনগণ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কোথাও কোথাও চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আরো ভেঙে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন স্থায়ী কমিটির নেতারা।

বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান (ভার্চুয়ালি), মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (ভার্চুয়ালি), সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (ভার্চুয়ালি), মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম) ও ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement