০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ৮ রজব ১৪৪৬
`

হতাশ সর্মথক, লাভবান জার্মানি

হতাশ সর্মথক, লাভবান জার্মানি - এএফপি

সমর্থক যে দলেরই হোক গ্রুপ পর্ব থেকে বর্তমান চ্যাম্পিয়ান জার্মানির বিদায় মেনে নিতে পারছেন না কোন ফুটবল প্রেমীই। অথচ সমর্থকদের হতাশার সাগরে ভাসানো এই হার নাকি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করেছে জার্মানিকে।

জার্মান সংবাদমাধ্যম দ্য লোকালের খবরে বলা হয়েছে, জার্মানির খেলা থাকলেই নাকি শ্রমিকরা নির্দিষ্ট সময়ের আগে কাজ ছেড়ে চলে যায়। এতে উৎপাদক প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্ধনীতিতে। তার একটি হিসাব দিয়েছে তারা। যাতে দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি ম্যাচেই দেশটির ক্ষতি হয়েছে ২০০ মিলিয়ন ইউরো, বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।

বিশ্বকাপে এখন আর জার্মানির কোনো খেলা নেই। তাই শ্রমিকরা নিয়মিত কাজে যোগ দেবে। এতে তাদের অর্থনীতিও লাভবান হবে।

বুধবার গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে জার্মানি ২-০ গোলে হেরেছে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে। ‘এফ’ গ্রুপ থেকে তিন ম্যাচের দুটিতে হার এবং একটিতে জয় পেয়েও কোনো লাভ হয়নি, ৩ পয়েন্ট পেয়ে গ্রুপে তলানিতে থেকে আসর থেকে বিদায় নেয় তারা।

জার্মানির এই হারে বিশ্বকাপে আরেকটি অঘটন হয়েছে। এ নিয়ে পাঁচ বিশ্বকাপের চারটিতে চ্যাম্পিয়নরা প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নেয়। ২০০২ সালে গ্রুপ পর্বের বাধা পেরোতে পারেনি ১৯৯৮ সালের শিরোপাজয়ী ফ্রান্স। ২০১০ সালে একই দশা হয়েছিল ২০০৬ সালের শিরোপাজয়ী ইতালির। আর ২০১৪ সালের সর্বশেষ বিশ্বকাপেও গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল ২০১০ সালের শিরোপাজয়ী স্পেন। এবারের বিশ্বকাপে এই তিন ইউরোপিয়ান পরাশক্তির সঙ্গে যোগ দিল চারবারের শিরোপাজয়ী জার্মানিও।

 

আরো পড়ুন: যে ভুলের কারণে বিদায় হলো জার্মানি


চার বছর আগে জার্মানিকে বিশ্বকাপ জেতানো কোচ জোয়াকিম লো'র এবারের বিশ্বকাপের দল বাছাই নিয়েই সমালোচনা তৈরি হয় আসর শুরুর আগে। আর আসরে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ হওয়ার পর নিশ্চিতভাবে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়বেন তিনি।

বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ২২ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড লিরয় সেইনকে রাখেননি তিনি। গত মৌসুমে এই ফরোয়ার্ড ম্যানচেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল দেয়া মারিও গোয়েৎজেকেও দলে রাখেননি তিনি।

দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে পাঁচটি পরিবর্তন নিয়ে একাদশ সাজান লো। থমাস মুলারকে বসিয়ে মেসুত ওজিলকে খেলালেও আর্সেনাল মিডফিল্ডার দলকে জয় এনে দিতে পারেননি।

২০০৬ থেকে জার্মানির দায়িত্বে থাকা লো দলকে ২০০৮ এর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নিয়ে যান। তার অধীনেই পরবর্তীতে বিশ্বকাপ জেতে জার্মানরা।

তবে লো'র দলের প্রধান কয়েকজন খেলোয়াড়ের ভবিষ্যতে এখন শঙ্কার মুখে।

ম্যানুয়েল ন্যয়ারের বয়স ৩২, স্যামি খেদিরা'র ৩১ আর ওজিল ও মার্কো রয়েসের বয়স ২৯। অর্থাৎ বিশ্বকাপের মূলপর্বে তাদেরকে আর খেলতে নাও দেখা যেতে পারে। তবে লো বলেছেন জার্মানির ফুটবলে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ রয়েছে।

তিনি বলেন, "এই হার কি জার্মান ফুটবলে অন্ধকার অধ্যায় শুরু করবে? আমার মনে হয় না।"

গোলের সুযোগ হাতছাড়া করার মাশুল

গ্রুপ এফ'এর আরেক খেলায় যখন মেক্সিকোর বিপক্ষে ৩-০ গোলে জিতছিল সুইডেন, তখন দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে গোল দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল জার্মানি।

জার্মানি জিতলে গোল ব্যবধানে মেক্সিকোর বাদ পড়তো বিশ্বকাপ থেকে। কিন্তু তখন উল্টো গোল করে বসে দক্ষিণ কোরিয়া।

তবে কিমের গোল শুরুতে অফসাইডের কারণে বাতিল করে দেয়া হয়।

তবে ভিডিও রিভিউ করে দেখা যায়, জার্মান মিডফিল্ডার টনি ক্রুসের গায়ে লেগে কিমের কাছে বল আসে। কাজেই বাতিল করে দেয়া হয় অফসাইডের সিদ্ধান্ত আর এগিয়ে যায় দক্ষিণ কোরিয়া।

ম্যাচে ফেরার জন্য মরিয়া জার্মানদের হয়ে আক্রমণে যোগ দেন গোলরক্ষক ন্যয়ারও।

আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগান টটেনহাম ফরোয়ার্ড সন হিউং-মিন। আক্রমণভাগে থাকা ন্যয়ারের অনুপস্থিতির সুযোগে খালি পোস্টে গোল করে নিশ্চিত করেন ২-০ গোলের জয়।

দুই গোল খেলেও ম্যাচে জার্মানির হতাশা হয়ে থাকবে কয়েকটি গোলের সুযোগ হাতছাড়া করা।

লিয়ন গোরেৎজকার একটি হেড দারুণভাবে ঠেকিয়ে দেন দক্ষিণ কোরিয়ার গোলরক্ষক চো হিয়েওন-উ। সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেন টিমো উইনারও। প্রায় ১২ গজ দূর থেকে পোস্টের বাইরে শট নেন তিনি।

দক্ষিণ কোরিয়া দুই গোল দেয়ার আগে একটি সুযোগ হাতছাড়া করেন ম্যাটস হামেলসও। ছয় গজ দূর থেকে নেয়া তার হেড চলে যায় পোস্টের উপর দিয়ে।

এই হারের সাথে হতাশাজনক ভাবে শেষ হলো জার্মানির টানা দুই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।

আবারো চ্যাম্পিয়নদের অকাল বিদায়

- আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপের শেষ পাঁচ আসরের মধ্যে গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নেয়া চতুর্থ দল জার্মানি (২০০২ এ ফ্রান্স, ২০১০ এ ইটালি আর ২০১৪'তে স্পেন)

- বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে জার্মানির বাদ পড়ার ঘটনা ঘটলো দ্বিতীয়বারের মত। ১৯৩৮ সালে শেষবার তারা প্রথম রাউন্ডে বাদ পড়েছিল। আর বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড গ্রুপ পদ্ধতিতে হওয়ার পর থেকে এই প্রথমবার জার্মানির সাথে ঘটলো এমন ঘটনা।

- আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি এবার গোল করেছে দুটি, যা বিশ্বকাপে কোনো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের জন্য দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নের সবচেয়ে কম গোল করার রেকর্ড ফ্রান্সের। ১৯৯৮ এর চ্যাম্পিয়নরা ২০০২'এ একটিও গোল করতে পারেনি।

- বিশ্বকাপে কোনো এশিয়ান দলের সাথে খেলা ছয় ম্যাচে এটিই ছিল জার্মানির প্রথম হার।

- সন হিউং-মিনের গোলটি (৯৫:৫২) বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে জার্মানির সবচেয়ে বেশি সময়ে গোল খাওয়ার রেকর্ড।

 

আরো পড়ুন : শিরোপাধারীর 'অভিশাপে' ছিটকে পড়লো জার্মানি!

বিশ্বকাপের গত আসরের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ২-০ গোলের হারে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়েছে।

এবার বিশ্বকাপে এফ গ্রুপে জার্মানি তিনটি খেলা খেলেছে। কিন্তু জিতেছে মাত্র একটিতে। সেই জয়টাও তারা পেয়েছিল সুইডেনের বিরুদ্ধে খেলার শেষ মুহুর্তে ৯৫ মিনিটে গোল করে।

আবারও বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নের গায়ে অভিশাপ আঘাত করলো।

আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, এটি একবিংশ শতাব্দীর অভিশাপ।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে ২০০২ সাল পর্যন্ত দুইবার শিরোপাধারীদের টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ার ঘটনা ঘটেছিল।

এর একটি ঘটনা ছিল ১৯৫০ সালে। তখন ১৯২৮ এর চ্যাম্পিয়ন ইতালি বাদ পড়েছিল (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ এ বিশ্বকাপ হয়নি)।

আর ১৯৬২'র চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল ১৯৬৬ সালে বাদ পড়েছিল পর্তুগাল এবং হাঙ্গেরি থেকে পিছিয়ে থাকার কারণে।

২০০২ সালে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপে উদ্বোধনী খেলাতেই সেনেগালের কাছে গোল খেয়ে ছিটকে পড়েছিল আগের বারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। অথচ সেটাই ছিল সেনেগালের প্রথম বিশ্বকাপ।

২০১০ সালে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো। ২০০৬ সালের চ্যাম্পিয়ন ইতালি গ্রুপ পর্বের বাধা পেরুতে পারলো না।

চার বছর পর ২০১৪ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন স্পেন।

এখন আবার একই ঘটনা ঘটলো। সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মোক্সিকোর কাছে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে জার্মানি, এটা মানুষের ভাবনায় ছিল না।

গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর কাছে হেরে দ্বিতীয় ম্যাচে সুইডেনকে হারিয়ে লড়াইয়ে ফিরেছিল জার্মানরা।

কিন্তু অপেক্ষাকৃত সহজ প্রতিপক্ষ দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে শেষমুহুর্তের গোলে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়তে হলো জার্মানিকে।

বিশ্বকাপের আগে টানা পাঁচ ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়া কোনো ম্যাচে জয়ী হতে পারেনি। তারাই হারিয়েছে জার্মানিকে।

ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের সাথে যেন অদৃশ্য এক অভিশাপই লেগে গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement