২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নাম পরিবর্তন করবে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, কিন্তু ধারণায় পরিবর্তন আসবে কি?

- ছবি : সংগৃহীত

"ছোটবেলায় আমি খেলাধুলা করতে পছন্দ করতাম, কিন্তু বাসার সবাই বলতো, এই বাইরে খেলাধুলা করোনা, এমনি কালো, আরও কালো হয়ে যাবি। একটু বড় হওয়ার পর বলতো রং ফর্সাকারী ক্রিম মাখতে। তাদের খালি একটাই চিন্তা আমার বিয়ে কীভাবে দিবে,"- গায়ের রং কালো হওয়ায় এমন নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বড় হওয়ার কথা জানাচ্ছিলেন ঢাকার বাসিন্দা মারফিয়া হায়দার।

গায়ের রং নিয়ে পারিবারিক অনুষ্ঠানে কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় মজার ছলে হলেও তাকে কম হেয় করা হয়নি।

"আমাকে দেখে অনেকের একটা কমন মন্তব্য, 'তুমি দেখতে খুব মিষ্টি, শুধু গায়ের রংটা চাপা,'- আবার বলে 'এই রঙের জামা পড়ো না, তোমাকে মানাবে না।"

শুধুমাত্র নারীদের নয়, গায়ের রংয়ের কারণে অনেক পুরুষকেও এমন হীনমন্যতা নিয়ে বড় হতে হয়েছে। তাদেরই একজন সরদার শাওন।

তিনি একটি সংগঠন করেন কিন্তু ওই সংগঠনের কোন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা বা গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্য রাখার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র গায়ের রং কালো হওয়ায় তাকে কখনও এই দায়িত্ব দেয়া হয়নি বলে তিনি মনে করেন।

এসব কারণে নিজের গায়ের রং কালো হওয়া সত্ত্বেও জীবনসঙ্গী হিসেবে ফর্সা মেয়েকেই বেছে নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

তিনি চান না তার ভবিষ্যৎ বংশধর কালো হোক।

শাওন বলেন, "বিয়ে এটা সুদূরপ্রসারী চিন্তা। তাই আমি চাই আমার বউ যেন ফর্সা হয়। আমাকে যেভাবে সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে, কটু কথা শুনতে হয়েছে। আমি চাই না আমার সন্তান একইরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাক।"

গায়ের রং নিয়ে মানুষের মনে গেঁথে থাকা এমন ধারণাকে পুঁজি করে বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে রং ফর্সাকারী কসমেটিক্সের বিশাল বাজার।

ফেয়ারনেস ক্রিমের এসব বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, তাদের ক্রিম ব্যবহারের ফলে একজনের চেহারা ধীরে ধীরে কালো থেকে ফর্সা হয়ে উঠছে। আর এই ফর্সা হয়ে ওঠার ফলে তিনি পৌঁছে গেছেন জীবন এবং ক্যারিয়ারের সফলতার শিখরে।

এসব বিজ্ঞাপন একটা অর্থই বহন করে যে, ফর্সা ত্বক হচ্ছে সফলতার প্রতীক। যা প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে থাকা বর্ণবাদকে উস্কে দিচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সাদেকা হালিম।

তিনি বলেন, "রং ফর্সাকারী ক্রিম মেখে বা রূপচর্চা করে গায়ের রং কালো থেকে ফরসা করার চেষ্টা এক ভয়াবহ সামাজিক চিত্র ফুটিয়ে তুলছে।"

এসব পণ্যের বিজ্ঞাপন ও বিক্রির বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশে প্রতিবাদ কম হয়নি।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঝড় বয়ে যায়।

তারই ধারাবাহিকতায় রং ফর্সাকারী পণ্য বা বর্ণবৈষম্য সমর্থন করে এমন পণ্যগুলো নিষিদ্ধের চাপ সৃষ্টি হয়।

চাপ আসে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতে সুপরিচিত ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ব্র্যান্ডটির ওপরেও। গত দুই সপ্তাহে বিশ্বব্যাপী চেঞ্জ অর্গানাইজেশনের তিনটি পিটিশন বিশ্ব বাজার থেকে এই ক্রিম নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে।

'ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি'র বিরুদ্ধে বর্ণবৈষম্যের অভিযোগে কয়েক হাজার মানুষ স্বাক্ষর করেছিলেন। সেখানে এশিয়া এবং পশ্চিমের এশিয়ান দোকানগুলো থেকে ক্রিমটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে।

ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির বিজ্ঞাপন ও বিক্রি নিষিদ্ধের দাবিতে ভারতে শত শত মানুষ টুইট করেছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বখ্যাত রং ফর্সাকারী ব্র্যান্ড 'ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, তাদের ক্রিমের নাম থেকে 'ফেয়ার' অর্থাৎ 'ফর্সা' শব্দটি বাদ দেয়ার কথা জানিয়েছে।

ফেয়ার এন্ড লাভলির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার এক বিবৃতিতে এই ঘোষণা দেয়। ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য নিশ্চিত করে।

কালো রংকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এই ব্র্যান্ডটি অতীতেও নানা সমালোচনার শিকার হয়েছে। তাদের বিজ্ঞাপনের মূল বিষয় ঘুরে ফিরে একটাই যে প্রেমের সন্ধানে বা আকর্ষণীয় চাকরি পেতে ফর্সা রং চাই।

ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মেখে গায়ের রং ফর্সা হতেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় এমন বিজ্ঞাপনও তারা প্রচার করেছে।

ক্রিমের প্রচারে ফর্সা, উজ্জ্বল এসব শব্দের ব্যবহার বর্ণ-বৈষম্যকে উস্কে দিয়েছে বলে স্বীকার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই সৌন্দর্যের ধারণায় আরও গ্রহণযোগ্যতা আনতে নাম পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সেখানে জানানো হয়।

তারা বলছে, 'ব্র্যান্ডটির নতুন নাম অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নামটি পরিবর্তিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।'

সত্তরের দশক থেকে যাত্রা শুরু করা এই ক্রিম বাজারে আসার পর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ভারতে এখনও বছরে ২৪০০ কোটি রুপি ব্যবসা করে এই একটি মাত্র পণ্য।

কালো মানেই অসুন্দর, অমঙ্গল?
বাংলাদেশেও প্রচলিত নিয়মে কেউ দেখতে সুন্দর কি না, সেটার পেছনে মূল মাপকাঠি থাকে তার গায়ের রং কতোটা ফর্সা। যার গায়ের রঙ যতো ফর্সা সে সুন্দর ও আকর্ষণীয়। আর কালো ত্বক মানে সেটা 'ময়লা' বা 'চাপা'।

সাদেকা হালিমের মতে, অধিকাংশ মানুষের চিন্তা চেতনার মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, কালো মানেই অসুন্দর, অমঙ্গল।

"আমরা খুব ভালো মানুষ বোঝাতে বলি সাদামনের মানুষ। কালো হৃদয়, কালো ইতিহাস বা কালো রাত, অর্থাৎ নেতিবাচক কিছু বোঝাতে ব্যবহার হয় 'কালো' শব্দটি।"

"এছাড়া শিল্প, সাহিত্য, সিনেমায় সৌন্দর্য বলতে, দুধে-আলতা রংয়ের বর্ণনাই উঠে এসেছে বার বার। শিশুদের রূপকথার গল্প কিংবা কার্টুনেও ফর্সা রঙের বন্দনা।"

ভারতবর্ষ দীর্ঘ দিন ফর্সা বর্ণের শাসকদের দ্বারা শাসিত হওয়ার ফলে এই ফর্সা ত্বককে সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা, এমনকি সৌন্দর্যের সাথে মেলানো হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

"আমাদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে আর্য, মুঘল বিশেষ করে ব্রিটিশরা শাসন করেছে। বর্ণবাদটা ঢুকে পড়েছে সেই সময় থেকেই।"

পাঁচ দশকের পুরনো বহুল জনপ্রিয় এই ব্র্যান্ডটির নাম পরিবর্তনকে স্বাগত জানালেও এটি যুগ যুগ ধরে চলে আসা মানসিকতায় কতোটা পরিবর্তন আনবে, এসব পণ্যের চাহিদা আদৌ কমবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সাদেকা হালিম।

তিনি বলেন, বাজারে এসব রং ফর্সাকারী ক্রিম আসার আরও অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে কালো রংকে হেয় করে দেখা হতো। এটা রাতারাতি বদলাবে না। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা।

ওদিকে গত সপ্তাহ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান জনসন এবং জনসন ঘোষণা করেছে তারা তাদের দুটি রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিক্রি বন্ধ করে দেবে।

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তারই ধারাবাহিকতায় এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যে জনপ্রিয় দুটি ক্রিম উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি। বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement