২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রোস্টভের সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে ওয়াগনার বাহিনী!

রোস্টভের সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে ওয়াগনার বাহিনী! - ছবি : সংগ্রহ

রাশিয়ার ভাড়াটে ওয়াগার বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝি দাবি করেছেন যে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ নগরী রোস্টভ-অন-ডনের সেনাবাহিনীর সদরদফতর তারা দখল করে নিয়েছে। তার যোদ্ধারা নগরীর সামরিক স্থাপনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে বলেও তিনি দাবি করেন।

প্রিগোঝিন টেলিগ্রামে এক ভিডিওবার্তায় বলেন, 'আমরা সেনাবাহিনীর সদরদফতরের অভ্যন্তরে। এখন সকার সাড়ে ৭টা (৪:৩০ জিএমটি)।

এদিকে গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন সশস্ত্র বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছেন এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে এবং তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে ক্রেমলিন।

প্রিগোঝিন ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি যেকোনো মূল্য রাশিয়ান সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের পতন ঘটাবেন। এরই মধ্যে তিনি ইউক্রেন থেকে সীমান্তের লাগোয়াবর্তী রাশিয়ার রোস্টভ অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন এবং একটা রাশিয়ান হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছেন বলে দাবি করছেন।

রাশিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলে পরিস্থিতির খুব দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। আধাসামরিক বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ এই মুহূর্তে দক্ষিণাঞ্চলের শহর রোস্তভ-অন-ডনের গুরুত্বপূর্ণ সব সাইট দখল করেছে বলে দাবি করেছেন প্রিগোঝিন।

ভরোনেঝ অঞ্চলের গভর্নর অনুরোধ করেছেন সাধারণ মানুষদের মহাসড়ক এড়িয়ে চলার। কারণ সে পথে রাশিয়ার মিলিটারি কনভয় আসছে। টেলিগ্রামে তিনি লিখেছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এবং জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য পরিকল্পনা নেয়া আছে।

সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায় ওয়াগনার যোদ্ধারা মিলিটারি কনভয় সারি নিয়ে রোস্তভের রাস্তায় আছে।

এদিকে অনলাইনে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যেটাতে দেখা যাচ্ছে যে রোস্তভ-অন-ডনে অবস্থিত রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের মিলিটারি হেডকোয়ার্টার্সে ঢুকছেন প্রিগোঝিন।

ভিডিওতে প্রিগোঝিন বলছেন, তার সৈন্যরা শহর ঘেরাও করে নেবে এবং মস্কোর দিকে যাত্রা শুরু করবে যদি প্রতিরক্ষা প্রধান সের্গেই সুইগো এবং ভ্যালেরি গেরাসিমভ তার সাথে দেখা না করেন।

বিবিসির পক্ষে ভিডিওটির সত্যতা যাচাই সম্ভব হয়নি ও আমরা এটি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি এবং বিস্তারিত পাওয়া মাত্র আপনাদের সামনে হাজির করবো।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধে লিপ্ত ভাড়াটে ওয়াগনার গ্রুপ। এর নেতা ৬২ বছর বয়সী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন বিভিন্ন সময় যুদ্ধের কৌশল নিয়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর নেতৃ্ত্বের সমালোচনা করে আসছেন।

শুক্রবার তিনি তার দলের সৈন্যদের উপর এক মারাত্মক মিসাইল হামলার অভিযোগ করেন রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। মি. প্রিগোঝিন এই অভিযোগের পক্ষে কোন প্রমাণ দেখাননি তবে যারা এই হামলা করেছে তাদের শাস্তি দেয়ার শপথ নেন তিনি।

তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই মিসাইল হামলার কথা অস্বীকার করে এবং প্রিগোঝিনকে সবরকম ‘অবৈধ কার্যক্রম’ বন্ধের আহবান জানায়।

তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগ এনেছে ক্রেমলিন। তবে কোন সামরিক অভ্যুত্থানের কথা অস্বীকার করেছেন ওয়াগনার দলনেতা।

প্রিগোঝিন বলছেন, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ভেতর যে ‘শয়তান’ আছে তাদের থামাতে হবে এবং তিনি ‘ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই’-এর ঘোষণা দিয়েছেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছের লোক হিসেবে খ্যাত প্রিগোঝিন বলেছেন, যারাই তার বাহিনীর সামনে দাঁড়াবে তাদেরই ধ্বংস করে দেয়া হবে।

'যারা আমার সৈন্যদের এবং হাজার হাজার রাশিয়ান সৈন্যদের (যারা ইউক্রেনে যুদ্ধে লিপ্ত) হত্যা করেছে, তারা সাজা পাবে,' সামাজিক মাধ্যম টেলিগ্রামে এক অডিও পোস্টে একথা বলেন তিনি।

একইসাথে রাশিয়ার জনগণকেও তার সাথে থাকার আহবান জানান।

ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে অধিবাসীদের ঘরের ভেতর শান্ত থাকার আহবান জানিয়েছে স্থানীয় গভর্ণর।

এমফোর হাইওয়ে লিপেতস্ক ও ভরোনেঝ অঞ্চলের সীমান্তে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন লিপেতস্কের গভর্ণর। এমফোর মস্কোর সাথে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সংযোগ ঘটায় এবং একই সাথে রোস্তভ অঞ্চল ও এর প্রধান শহর রোস্তফ-অন-ডনেও যাবার রাস্তা এটি।

মস্কোর মেয়র জানিয়েছেন, রাজধানীতে সন্ত্রাস-দমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে নিরাপত্তা নিশ্চিতে।

পুরো রাশিয়াতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে এবং মস্কোর রাস্তায় সামরিক ট্রাকের দেখা মিলছে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র তাস নিউজ এজেন্সিকে জানিয়েছে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে টিভিতে ভাষণ দেবেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।

যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য ইন্সটিটিউট অফ ওয়্যার (আইএসডব্লিউ) বিশ্বাস করে যে ইয়েভগিনি প্রিগোঝিন ক্রেমলিনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটা জোরপূর্বক পরিবর্তন আনতে চান। তবে ক্রেমলিনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় তার জন্য ‘সাফল্য পাওয়া কঠিন’ হবে।

তবে রোস্তভ-অন-ডন দখলের চেষ্টা যুদ্ধে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। কারণ রোস্তভ হলো রাশিয়ার সাউদার্ন মিলিটারি ডিস্ট্রিক্ট কমান্ড, যা যুদ্ধে বড় অবদান রাখছে।

এখানকার সেনাবাহিনী ‘এই মুহূর্তে ইউক্রেন যে পাল্টা আক্রমণ করছে সেটা প্রতিহত করতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং একই সাথে পুরো ইউক্রেনে রাশিয়ার যৌথ বাহিনীর কমান্ড সেন্টার এখানে’।

এই লড়াইটাকে বিশ্লেষকরা দেখছেন রাশিয়ার ক্ষমতার শীর্ষে থাকা দুজনের লড়াই হিসেবে।

একদিকে ডাকসাইটে ওয়াগনার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা, অন্যদিকে রাশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, যারা দুজনই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যখন থেকে ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার যুক্ত হয়েছে তখন থেকেই রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর সাথে প্রিগোঝিনের একটা বিরোধ দেখা গেছে।

যার শুরুটা হয় বাখমুটের যুদ্ধ থেকে। রাশিয়ার সেনাবাহিনী যখন সুবিধা করে উঠতে পারছিল না তখন ওয়াগনার গ্রুপ ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ ডনবাস অঞ্চলের এই শহর দখল করে। এসময় প্রিগোঝিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে যথেষ্ট অস্ত্র সরবরাহ না করার অভিযোগ করেন।

গত মে মাসে এক ভিডিও বার্তায় তিনি তার সৈন্যদের লাশের মাঝে দাঁড়িয়ে সের্গেই শোইগু ও চিফ অফ জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। শুক্রবার প্রিগোঝিন দাবি করেন ইউক্রেনে যুদ্ধটা করাই হচ্ছে 'যাতে শোইগু মার্শাল হতে পারেন।'

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ওয়াগনার গ্রুপের উপর রাশিয়ান বাহিনীর হামলা নিয়ে 'সামাজিক মাধ্যমে প্রিগোঝিন যেসব ছড়াচ্ছেন' সেগুলো 'সত্যি নয়। এগুলো উত্তেজনা ছড়াচ্ছে।'

রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ডেপুটি প্রধান জেনারেল সের্গেই সুরুভিকিন প্রিগোঝিনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ‘কনভয় থামিয়ে নিজেদের ঘাঁটিতে ফেরত যাবার’।

ওয়াগনার বাহিনী কারা?
বিবিসির এক অনুসন্ধানে বলা হয়, চেচনিয়ায় যুদ্ধ করা একজন রুশ সেনা কর্মকর্তা দিমিত্রি উটকিন সম্ভবত এই বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তবে বর্তমানে এর প্রধান হচ্ছে ধনী ব্যবসায়ী ইয়েভগেনি প্রিগোশিন– যাকে পুতিনের রাঁধুনী বলা হয় কারণ একসময় তিনি ক্রেমলিনের জন্য খাবার সরবরাহ করতেন।

ক্রাইমিয়া দখলের জন্য রাশিয়ার ২০১৪ সালের যুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধারা প্রথম ভুমিকা পালন করে। এর পর ২০১৫ সালে সিরিয়াতে সরকারসমর্থক বাহিনীর পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করে ওয়াগনার বাহিনী, এবং সেসময় তারা তেলের খনিগুলোও পাহারা দিত।

তা ছাড়া ওয়াগনার বাহিনী ভাড়াটি সৈন্যরা লিবিয়ায় জেনারেল খলিফা হাফতারের সহযোগী হিসেবে, এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে হীরার খনি পাহারা দিতে কাজ করে।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির সরকার ইসলামি জঙ্গী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওয়াগনার বাহিনীকে কাজে লাগাচ্ছে।

ধারণা করা হয়, সুদানে সোনার খনি পাহারা দেবার কাজ করছে ওয়াগনার বাহিনীর যোদ্ধারা।

মার্কিন সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধরত রুশ বাহিনীর প্রায় ১০ শতাংশ হচ্ছে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধা।

এর মধ্যে হাজার হাজার যোদ্ধা এসেছে রাশিয়ার কারাগারগুলোতে থাকা বন্দীদের মধ্যে থেকে।

প্রথমদিকে তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৫,০০০– যাদের অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন রেজিমেন্টের সাবেক সৈন্য।

তবে যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা বলেন, ক্রেমলিন নিয়মিত বাহিনীর জন্য লোক পেতে সমস্যায় পড়ার পর এই ওয়াগনার বাহিনী বড় সংখ্যায় সেনা নিয়োগ শুরু করে।

সূত্র : আল জাজিরা ও বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement