১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কে এই লুকাশেঙ্কো, ‘ইউরোপের শেষ স্বৈরশাসক’

- ছবি : সংগৃহীত

আলেকসান্ডার লুকাশেঙ্কোকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে ইউরোপের শেষ স্বৈরশাসক। গত ২৬ বছর ধরে তার ক্ষমতা শক্তভাবে ধরে রেখেছেন লুকাশেঙ্কো। কিন্তু গত নির্বাচনের পর থেকে তিনি ব্যাপক গণ বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন। বিতর্কিত নির্বাচনী ফলাফলের পর থেকে তার ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়ছে।

লুকাশেঙ্কো ১৯৯৪ সালে দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একমাত্র ওই একটি নির্বাচনই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বিবেচনায় অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল।

এরপর লুকাশেঙ্কো পুনর্নিবাচিত হয়েছেন আরও পাঁচবার। যার মধ্যে রয়েছে এবছর নয়ই অগাস্টের সর্বশেষ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে তিনি ৮০ ভাগ ভোট পেয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। এরপরই বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের জনগণ, নজিরবিহীন প্রতিবাদ দেখাতে পথে নেমেছে দেশটির মানুষ।

কে এই আলেকসান্ডার লুকাশেঙ্কো? ২৬ বছর ধরে তার ক্ষমতা ধরে রাখার রহস্যটা কি?

খামার থেকে ক্ষমতার মসনদে
লুকাশেঙ্কোর ক্ষমতায় উত্থান শুরু হয় ১৯৯০ সালে বেলারুশের সংসদে তিনি নির্বাচিত হবার মধ্যে দিয়ে। সংসদে দুর্নীতি দমন কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে তার ভূমিকা ছিল খুবই উদ্দীপনাময়।

খুবই সাধারণ পরিবার থেকে তার উঠে আসা। পূর্ব বেলারুশের এক দরিদ্র গ্রামে একা মা তাকে বড় করেছিলেন।

স্নাতক পাশ করেন লুকাশেঙ্কো ১৯৭৫ সালে, শিক্ষক হন এবং এরপর দু বছর রাজনীতির প্রশিক্ষক হিসাবে বাধ্যতামূলক সেবা দেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

কৃষি ও শিল্প অর্থনীতিতে ডিগ্রি লাভ করেন করেসপডেন্স কোর্সের মাধ্যমে এবং ১৯৮৫ সালে একটি সমবায় খামারের চেয়ারম্যান হন, যার ফলশ্রুতিতে তাকে ১৯৮৭ সালে দেশের পূর্ব-মধ্যাঞ্চলীয় মাহিলিও এলাকায় একটি রাষ্ট্রীয় খামারের পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়।

দেশটির ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য জনগণের প্রার্থী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ওয়াশিংটনে অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের একজন বিশেষজ্ঞ অ্যানডার্স আসলান্ড বলছেন তখন তার প্রচারণার মূল ফোকাস ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান। এছাড়া তার আর কোন লক্ষ্য বা সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা ছিল না।

কিন্তু ক্ষমতায় বসার পরই তার কম্যুনিস্ট প্রতিপক্ষ যেসব নীতির ভিত্তিতে লড়ে ভোটে হেরেছিলেন, তার বেশিরভাগই লুকাশেঙ্কো নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেন। তার প্রতিপক্ষ ওই নির্বাচনে পেয়েছিলেন ১৪ শতাংশ ভোট, আর লুকাশেঙ্কো পান ৮০ শতাংশ ভোট।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যেসব আকস্মিক ও নাটকীয় নীতিমালা নেয়া হয়েছিল তিনি তার বিরোধিতা করেন এবং দেশের অর্থনীতি পরিচালনা করেন মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানার ভিত্তিতে। দেশটির সংবাদ মাধ্যম এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপরও তিনি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব পুরোপুরি বজায় রাখেন।

'স্বৈরাচারী স্টাইল'
লুকাশেঙ্কোর শাসন পদ্ধতিকে সোভিয়েত জমানার স্বৈরাচারী স্টাইলের বলে বর্ণনা করা হয়। তিনি দেশের প্রধান সংবাদ চ্যানেলের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের হয়রানি করার ও প্রয়োজনে জেলে ভরার নীতি অনুসরণ করেছেন এবং নিরপেক্ষদের কণ্ঠরোধ করে তাদের একঘরে করেছেন।

তিনি ২০০৩ সালে বলেছিলেন, "আমার বৈশিষ্ট্য হল স্বৈরাচারী স্টাইলের শাসন। আমি সবসময়ই সেটা স্বীকার করেছি। দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। মূল কথা হলো জনগণের জীবনকে ধ্বংস না করা।"

শক্তিশালী গোয়েন্দা পুলিশ -এখনও সেখানে কেজিবি নামেই পরিচিতি- ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর কড়া নজর রাখে। এদের বেশিরভাগই হয় জেলে নয় নির্বাসনে। প্রেসিডেন্টকে অপমান করা - এমনকি মজা করা হলেও - তার শাস্তি কারাবাস।

বেলারুস ইউরোপের একমাত্র দেশ এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একমাত্র দেশ যেখানে এখনও মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়াও গোপনীয়তায় ঢাকা।

মাথায় গুলি করে কত মানুষের মৃত্যুদণ্ড যে কার্যকর হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় ১৯৯৯ সালের পর থেকে ৩০০র বেশি মানুষকে এভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

করোনা মোকাবেলায় ভদকা
পশ্চিমা দেশগুলো থেকে পরিবর্তনের জন্য চাপ সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট তার নীতিতে অনড় থেকেছেন।

দেশটি ২০১১ সালে চড়া মুদ্রাস্ফীতির সংকটে পড়ে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ-এর পূর্বাভাস ছিল ২০২০ সালে দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দার হার হবে ৬ শতাংশ। কিন্তু দেশটিতে বেকারত্ব প্রায় নেই বললেই চলে এবং বেলারুশের রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ বাজার এখনও রাশিয়া।

মে মাসের শেষ নাগাদ যখন বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ লকডাউনের মধ্যে ছিল, তখন লুকাশেঙ্কো বলেছিলেন বেলারুশের অবস্থা অনেক ভাল। এবং দেশটিতে লকডাউন না দেবার জন্য তাদের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।

"দেখুন স্বচ্ছল পশ্চিমা দেশগুলোতে বেকারত্ব লাগামহীন পর্যায়ে। লোকে থালাবাসন বাজাচ্ছে। লোকের খাওয়া জুটছে না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমরা সেটা এড়াতে পেরেছি, আমরা সব কিছু বন্ধ করিনি," তিনি বলেন।

তবে করোনা মহামারি লুকাশেঙ্কোর জন্য কিছুটা বিব্রতির কারণও হয়েছে। প্রথমদিকে তিনি কোভিড-১৯ মহামারির বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বলেন এটা গণহারে পাগলামো "মানসিক প্রলাপ"। তিনি এই ভাইরাস কাটাতে ভদকা মদ পান করার এবং উষ্ণ বাষ্পের স্নানাগার বা সনায় গিয়ে বসে থাকার পরামর্শ দেন।

জুলাই মাসে তিনি এই ভাইরাসকে মেনে নেন যখন তিনি নিজেই পজিটিভ শনাক্ত হন। তবে কোনরকম উপসর্গ তার ছিল না এবং তিনি সেরে ওঠেন।

সোভিয়েত নস্টালজিয়া
ভ্লাদিমির পুতিনের মত লুকাশেঙ্কোও সোভিয়েত ইউনিয়নের স্মৃতিকাতর। তিনি সেসময়কার নস্টালজিয়া ধরে রাখতে চান।

তবে ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে মি. লুকাশেঙ্কোর আনুগত্য স্পষ্ট। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যা তার ভাষায় "বহু মেরু বিশিষ্ট বিশ্বের স্তম্ভ" এবং রাশিয়া এর মধ্যে পক্ষ সমর্থনে তার কোন দ্বিধা নেই। রাশিয়া তার ভাষায় "ভাই"।

"ভাইকে বেছে নিতে লাগে না। কাজেই আমরা রাশিয়ার সাথে আছি নাকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে - এ প্রশ্ন আমাদের করবেন না," তিনি মন্তব্য করেছিলেন ২০১৭ সালে।

তিনি ২০১৮র ডিসেম্বরে মস্কোয় পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে নববর্ষের উপহার হিসাবে চার বস্তা আলু এবং সালো নামে শূকরের বিশেষভাবে কাটা চর্বি দেন।

বেলারুশের প্রেসিডেন্টের তথ্য সচিব জানান ওই আলু ভিন্ন জাতের এবং ভিন্ন স্বাদের এবং বেলারুশের ওই খাবারগুলো পুতিনের বিশেষ প্রিয়।

'পুরুষের মুখের কথা'
জর্জিয়া এবং প্রতিবেশি ইউক্রেনে সনাতনপন্থী শাসকদের যেভাবে পতন ঘটানে হয়েছে লুকাশেঙ্কো তার দেশে সেধরনের বিপ্লবের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।

নির্বাচনী প্রচারণার সময়, তিনি একথাও বলেন যে বেলারুসের সমাজ "কোন নারীর পক্ষে ভোট দেবার জন্য তৈরি নয়, কারণ সংবিধানে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য সবল কর্তৃত্ব ন্যস্ত করা আছে"। তার প্রধান প্রতিপক্ষ এখন প্রত্যেকেই নারী।

কোন কোন বিশ্লেষক বলছেন লুকাশেঙ্কোর ওপর পদত্যাগের জন্য নজিরবিহীন চাপ তৈরি হয়েছে- অনেকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন আগের নির্বাচনগুলোর পরেও তার ওপর চাপ এসেছিল এবং তিনি টিকে গিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো ১৭ই অগাস্ট রাজধানী মিনস্কে কারখানা শ্রমিকদের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে শ্রমিকদের হেনস্থার শিকার হন। তাকে দেখা যায় বিরক্তি প্রকাশ করে বেরিয়ে যেতে। তিনি বলেন সমাবেশে উপস্থিতরা তাকে "গো" (সরে যান) বলে যত খুশি চেঁচাতে পারে। এবং তারা সেটা আসলে করেনও।

একিই দিনে, একটি গাড়ি নির্মাণ কারখানায় ভাষণ দেবার সময় তিনি বিক্ষোভকারীদের হুঁশিয়ার করে দেন যে তারা "লাল দাগের সীমায় পৌঁছে গেছে"। তিনি সতর্ক করে দেন "যদি এই সীমা অতিক্রম করেন, তাহলে তার পরিণাম ভোগ করতে হবে। যদি পথে নামেন, আমরা ব্যবস্থা নেব," খবর দেয় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেলটা সংবাদ সংস্থা।

"আপনারা যদি সব কিছু ভাঙতে শুরু করেন, আপনাদের যথাযথ জবাব দেয়া হবে। একজন পুরুষের মুখ থেকে এটা শুনে রাখুন।" বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
অক্টোবরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩৭৭ ‘মওলানা ভাসানী সব সময় ত্যাগের রাজনীতি করেছেন’ ১০০ দিনে ৮৬২৭৭ জনের কর্মসংস্থান করেছে অন্তর্বর্তী সরকার ইসরাইলের প্রতি বার্লিনের সমর্থনের বিরুদ্ধে জার্মান বুদ্ধিজীবীরা : ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা চিঠি ‘জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান সফল করতে এগিয়ে আসতে হবে’ গাজার সড়কগুলোতে ৩ লাখ টন বর্জ্য নাঙ্গলকোটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ব্যবসায়ীর মৃত্যু নৌবাহিনীর জাহাজ ২১ নভেম্বর সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে দেশ টিভির এমডি আরিফ ২ দিনের রিমান্ডে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ আয়োজন করতে যাচ্ছে রাশিয়ার নির্বাসিত বিরোধী দল গাজীপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী ও পোশাককর্মী নিহত

সকল