ক্যামেরাকে কলম বানিয়েছিলেন গদার
- আলমগীর কবির
- ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০৫
জঁ-লুক গদারের জীবনাবসান কেবল একটি যুগেরই অবসান ঘটাল, তা নয়। এর মধ্য দিয়ে এই সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে সাহসী কণ্ঠস্বর নীরব হয়ে গেল। যেকোনো মৃত্যুই অপূরণীয়, কিন্তু কিছু মৃত্যু পুরো বিশ্বের জন্য তৈরি করে অপূরণীয় শূন্যতা। জঁ-লুক গদারের মৃত্যু চলচ্চিত্রের এই দুঃসময়ে বিশ্ব সিনামার এক অভাবনীয় শূন্যতা তৈরি করে দিলো। ‘ব্রেথলেস’-এর মতো কালজয়ী সিনেমা বানিয়ে সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। ফরাসি নিউ ওয়েভ আন্দোলনের পুরোধা গদারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশের খ্যাতিমান নির্মাতারা। ২০০২ সালে সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের এক জরিপে সমালোচকদের প্রদত্ত ভোটে সর্বকালের সেরা ১০ পরিচালকের তালিকায় তৃতীয় স্থানে ছিল গদারের নাম। ২০১০ সালে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সম্মানসূচক পুরস্কার দেয়া হয় তাকে। ২০১৮ সালে তার সিনেমা ‘ইমেজ বুক’ পায় স্পেশাল পাম দ’র। ২০১৪ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি পুরস্কার পায় তার ‘গুডবাই’।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র আন্দোলনের শেষ নক্ষত্র বলা যায় গদারকে। তাকে বলা হয় ফরাসি নিউ ওয়েভ আন্দোলনের গডফাদার। ক্যামেরাকে কলমের মতো ব্যবহার করেছেন তিনি। আবিষ্কার করেছেন নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব। ষাটের দশক থেকে সিনেমা নিয়ে তার নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা বহু পরিচালককে পথ দেখিয়েছে। চিরাচরিত পারিপাট্য, চিত্রায়ণের ব্যাকরণকে ধাক্কা দিয়েছিল গদারের হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার কাজ। তার হাতেই জন্ম নিয়েছিল জাম্প কাট।
গদারের নির্মিত সিনেমা অনুপ্রাণিত করেছে প্রখ্যাত নির্মাতা মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ রায়কেও। গদারের ফিল্ম টেকনিক আর ক্যামেরার ব্যবহার মুগ্ধ করেছে তাদের। বাংলাদেশের নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা চৌধুরীসহ অনেকের কাজেই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তার সিনেমা।
অর্ধশতাব্দীরও বেশি বিস্তৃত ছিল তার কর্মজীবন। তার ছবিগুলো ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিল। গদারের কাজ, যা হলিউডের পরিচালকদের যেমন কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনো, মার্টিন স্কোরসেস এবং রবার্ট অল্টম্যানকে প্রভাবিত করেছিল। এতে প্রবন্ধ, ডকুমেন্টারি এবং চলচ্চিত্র তৈরির বিষয়ে চলচ্চিত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গদার সিনেমা নির্মাণের আগ পর্যন্ত সিনেমা-সম্পর্কিত একরকম ধারণা পোষণ করত মানুষ। কিন্তু গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে গদার যখন চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিলেন এবং সব ধরনের চর্চিত নিয়মনীতিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজের মতো করে ছবি বানাতে শুরু করলেন, তখন অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী তাকিয়ে দেখেছে। এই নবতরঙ্গ সৃষ্টির লগ্নে তিনি সাথে পেয়েছিলেন আলাঁ খোসনে, ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফো, আগ্নেস ভার্দা, এরিক খোমার, ক্লদ শেব্রল, জ্যাক রিভেত প্রমুখের। আরও পেয়েছিলেন অদ্রেঁ বাজাঁর মতো সম্পাদককে। মূর্তি ভঙ্গকারী ঊর্মিমালার মাঝে একজন হলেও গদার স্বতন্ত্র, তার চিন্তাপদ্ধতি ঋজু, তাই প্রকাশ ভঙ্গিও সূর্যচুম্বিত বর্শার মতো।
গদারই প্রথম সিনেমার ভেতর গৎবাঁধা গল্প বলার ঢংকে জোরালো ভঙ্গিতে সংপ্রশ্নবিদ্ধ করলেন। বললেন, গল্পের একটা শুরু, মধ্যমা ও শেষ থাকতে হয় বটে, তবে সেটা যে ওই ক্রমেই থাকতে হবে, তার কোনো মানে নেই। বললেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে আপনি কোত্থেকে জিনিসটা নিলেন, নিয়ে কোন দিকে গেলেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ গন্তব্যই তার কাছে শেষ কথা। আরও বললেন, অমর হন, তারপর মারা যান। প্রকৃত অর্থেই তিনি অমর হয়ে মারা গেলেন ১৩ সেপ্টেম্বর, ৯১ বছর বয়সে।
তিনি সব সময় ছক ভাঙতে পছন্দ করতেন। আর এটা করতে গেলে আগে ছক জানতে হয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইটিতে বলেছেন, ‘গদারের প্রায় যেকোনো ছবি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তার একটি প্রধান লক্ষ্য হলো সিনেমার সনাতন রীতিগুলোকে অত্যন্ত সচেতনভাবে ভেঙে ফেলা। কাজেই গদারকে বোঝবার আগে বোঝা চাই এ সনাতন রীতিগুলোকে, যেমন প্রাক্-সেজান যুগের সনাতনী ইউরোপীয় পেন্টিং-এর সাথে পরিচয় না থাকলে, সেজানকে বোঝা যায় না।’
গদার একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, চলচ্চিত্র বানাতে নারী আর বন্দুকই যথেষ্ট, তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন ১৯৬০ সালে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ব্রেথলেসে’র মাধ্যমে। ক্রাইম ড্রামাটির ভেতর থাকা প্যাট্রিসিয়া প্রেমে পড়ে এক অপরাধী ব্যক্তির, নাম মিশেল। চলচ্চিত্রের শেষ অঙ্কে পুলিশের গুলিতে মারা যায় মিশেল, তবে ওই ছবি দেখে বিশ্ব চলচ্চিত্র গাঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠে, এর কারণ ছবিটির অভিনবত্ব। সম্পাদনায় জাম্পকাট, চরিত্রের ট্রিটমেন্ট এবং হলিউডের ক্রাইম জঁরার প্লট নিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিতে উপস্থাপন গদারকে সে সময় শুধু আলাদাই করে দেয়নি, বিশ্ব চলচ্চিত্রে স্থায়ী আসন করে দিয়েছে।
এই যে প্রচলিত রীতিকে ভেঙেচুরে অন্যরকম ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস গদারের ভেতর দেখা যায়, সেটি সিনেমার প্রতি গভীর জ্ঞান ও প্রেমের বহিঃপ্রকাশই বটে। নিজে নির্মাতা হওয়ার আগে সিনেমা দেখেছেন দিনরাত এক করে। একই ছবি বহুবার। বন্ধুদের মতোই তিনি প্রথমে ছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচক। সমালোচনাকালে যে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত পরিচালকের ছবি নাকচ করতেন, সেই ধারণাগুলোই পরবর্তী সময়ে নিজের ছবিতে কাজে লাগাতে থাকেন। ৯১ বছরের জীবনে দু’হাত ভরে সিনেমা বানিয়েছেন ‘চল্লিশের অধিক পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ছাড়াও প্রামাণ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, টিভি সিরিজ’ সব মিলিয়ে তাঁর সৃষ্টি শতাধিক।
জার্মান নাট্যতাত্ত্বিক বের্টল্ট ব্রেখটের মতো গদারও চাইতেন তার দর্শক যেন ক্রিটিক্যালি বা চিন্তার জারনের ভেতর দিয়ে তার কাজের অংশীজন হয়ে ওঠে। আর সেজন্য গদার এমন সব কৌশল প্রয়োগ করতে শুরু করেন, যাতে দর্শক প্রতিনিয়ত অনুধাবন করে, সে যা দেখছে তা বানানো, কৃত্রিম। গদার তাই বলতেন, সিনেমা হলো দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ঠগ এক জিনিস। গদার চাইতেন দর্শক যেন বাহাসের ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্রকে গ্রহণ করে। ‘লা শিনোয়াজ’ ছবিটির কথাই ধরা যাক। সেখানে নানা প্রকার ক্যাপশন শুধু নয়, তিনি চরিত্রদের দিয়ে চতুর্থ দেয়াল ভেঙে দিলেন, এমনকি ছবির শুরুতে ক্ল্যাপার বোর্ডটিও রেখে দিলেন। তিনি যেন প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিতে চান সিনেমা মানেই নির্মিত সত্য মাত্র।
তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই গদারকে সবাই অকুণ্ঠ ভালোবাসা দিয়েছেন বা সবাই তার কাজকে পছন্দ করেছেন। নিজেদের দেশে যেমন তার সমালোচক ছিল, তেমনি বিদেশেও কম ছিল না। তার চলচ্চিত্রের বক্তব্য তো বটেই, নিজের চোখা ও ধারালো মন্তব্যও তাকে ব্রাত্য করে দিয়েছিল অনেক পরিসরে। বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট যেমন একবার গদার সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি গভীরভাবেই নিজের দুনিয়ায় বুঁদ থাকেন, আর এ কারণেই তার ছবি একই সাথে স্বতন্ত্র ও হতাশাজনক হয়।
হলোইবা গদারের কাজ ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়াসংবলিত, নিরীক্ষাধর্মী, রাজনৈতিক কিংবা তিনটাই, কিন্তু সেসব কাজের যে প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের নির্মাতাদের ওপর পড়েছে তা অনস্বীকার্য। ফরাসি চলচ্চিত্রে নবতরঙ্গ খেলে যাওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানারূপে নবতরঙ্গ খেলে গেছে। সেসব দেশ তাদের নিজস্ব গদারকেও আবিষ্কার করে নিয়েছে যথারীতি। তাই বলতে দ্বিধা নেই, গদারের শারীরিক মৃত্যু হয়েছে সত্যি, কিন্তু সিনেমার ভাষা বিনির্মাণে তার যে বিপ্লবী প্রয়াস ও সাফল্য, সেটা তাকে জীবিতকালেই অমর করে দিয়েছিল।
কাজেই এখন যারা শিল্প সাহিত্যের ছক ভেঙে নতুন করে গড়তে চান, আগে দরকার সেটাকে গভীরভাবে জানা। পড়া, দেখা, মানুষ ও প্রকৃতিকে চেনা। জীবনকে গভীরভাবে অনুভব করা না গেলে কোনো কিছুই হয়ে ওঠা হয় না। পুরস্কার! সে তো বাড়ির শেলফে বা উইকিপিডিয়ায় থাকে। সৃজনশীলরা পাত্তাও দেন না। যেমন গদার যাননি অস্কার নিতে। সৃষ্টি আসলে নিজেকে উপভোগ এবং চ্যালেঞ্জের জন্য। গদার জানতেন। যেমন জানতেন আমাদের মানিক, সত্যজিৎ রায়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা