২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সেন্সরের পরিবর্তে সার্টিফিকেশন বোর্ড, পার্থক্য কী হলো

সেন্সরের পরিবর্তে সার্টিফিকেশন বোর্ড, পার্থক্য কী হলো -


সেন্সর বোর্ড বাদ দিয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড পুনর্গঠন করে গতকাল এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, ১৫ সদস্যবিশিষ্ট চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব।
আগে এর নাম ছিল ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড’। ওখান থেকে ‘সেন্সর’ শব্দটি বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে ‘সার্টিফিকেশন’। এখন এর নাম দাঁড়িয়েছে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’। এটি পুনর্গঠনের খবরটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। যেখানে সদস্য তালিকায় পাওয়া যায়নি আশফাক নিপুণ ও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের নাম। বাতিল হওয়া সেন্সর বোর্ডের বাকি সদস্যরা বহাল আছেন সার্টিফিকেশনেও।
আশফাক নিপুণ ও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের পরিবর্তে সেন্সর বোর্ড থেকে সার্টিফিকেশন বোর্ডে যুক্ত করা হয়েছে প্রযোজক, পরিচালক ও সংগঠক জাহিদ হোসেন এবং চলচ্চিত্র সম্পাদক ইকবাল এহসানুল কবিরকে।

কিন্তু সেন্সর বোর্ড থেকে সার্টিফিকেশনে রূপ নেয়ার মাঝের সাত দিনে ঘুরেফিরে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগের কাছেই প্রশ্ন ছিল, দুটোর আদলে আসলে পার্থক্য কী? নাম বদলানোর পর কাজের ধরন কেমন হবে? কিংবা আদৌ চলচ্চিত্র শিল্পের কোনো উপকারে আসবে এই পরিবর্তন? কেমন করে চলবে এই সার্টিফিকেশন? একে অপরের প্রতি এমন হরেক প্রশ্নে জেরবার চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা। উৎসুক সাধারণ চলচ্চিত্রপ্রেমীরাও।
সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় খিজির হায়াত খান বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন ইতিহাসের শুরুটা হলো। তবে অনেক কাজ বাকি। কারণ সার্টিফিকেশন আইন পাস হলেও এর বিধিগুলো তৈরি হয়নি। সেগুলো সবাই মিলে গবেষণার মাধ্যমে তৈরি করতে হবে। সেগুলোকে সর্বসম্মতিক্রমে পাস করাতে হবে। আমি মনে করি, আমাদের এই বোর্ডের মূল কাজ এখন এটাই। যদি এই কাজ যথাযথভাবে সততার সাথে আমরা করতে পারি, তাহলে নিজেকে এই বোর্ডের যৌক্তিক অংশ মনে হবে।’

অনেকেরই জানতে চাওয়া, সেন্সর বোর্ড ও সার্টিফিকেশন বোর্ডের কাজের মূল পার্থক্য কী? চলচ্চিত্রজনদের সাথে আলাপে এটুকু স্পষ্ট, সেন্সর বোর্ড চাইলে যেকোনো ছবিতে কাঁচি চালাতে ও নিষিদ্ধ করতে পারে, এমনকি ছাড়পত্র না দিয়ে ফেলে রাখতে পারে হিমাগারে। সাধারণত সার্টিফিকেশন বোর্ড এসব পারে না। এই বোর্ড সিনেমা দেখার পর গ্রেডিং দিয়ে ছেড়ে দিতে পারে। তাদের রায়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে দর্শকশ্রেণী। মোটা দাগে সার্টিফিকেশন বোর্ড মানে, সব সিনেমাই উন্মুক্ত! তারা শুধু সিনেমাটিকে এমন একটি গ্রেডিং করে দেয়, যাতে করে দর্শকরা আগাম ধারণা নিয়ে ছবিটি দেখতে যেতে পারেন প্রেক্ষাগৃহে। এটা দর্শকদের জন্য অনেকটা সেফগার্ডের মতো।

যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক চলচ্চিত্রজনই মনে করছেন, বাংলাদেশের জন্য এমন গ্রেডিং সিস্টেমে উন্মুক্ত চলচ্চিত্রনীতি পালন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সেন্সর বোর্ডের ছায়া ধরেই সার্টিফিকেশনের আইন প্রণয়ন হয়েছে। ফলে নাম বদলের বাইরে মূলত আর কিছুই বদলাবে না।
সেই আলোকে বোর্ড সদস্য খিজির হায়াত খান মনে করেন, ‘সার্টিফিকেশন বোর্ডকে কার্যকর করতে পুরো আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন দরকার। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের জন্য রক্ষাকবচের কথাও ভাবতে হবে। কারণ এমন সিনেমা নিশ্চয়ই মুক্তি পাবে না, যেটি দেখে দেশে ধর্মীয় কিংবা জাতিগত দাঙ্গার জন্ম হয়। ফলে সবাইকে নিয়ে সব ভেবেই কাজটি করতে হবে; যেখান থেকে সুফল পাবে সিনেমা, দেশ ও দর্শক।’
সার্টিফিকেশনেও যদি ‘রক্ষাকবচ’ নিয়ে ভাবা হয়, সেক্ষেত্রে বোর্ডের নাম বদল করে কি আদৌ কোনো সুরাহা হলো চলচ্চিত্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যতে? কারণ, যেসব ছবি সেন্সর বোর্ডে এখনো আটকে আছে, সেগুলো তো রাষ্ট্রের মঙ্গল ও শৃঙ্খলার কথা ভেবেই সদস্যরা আটকে রেখেছেন! এমনটাই জানা গেছে অতীত বোর্ড সদস্যদের মন্তব্যে।

এমন প্রসঙ্গের আলোকে নাম প্রকাশে অনাগ্রহী একজন সফল নির্মাতা বলেন, ‘নামটাই বদল হয়েছে। আর কিছু নয়। সেন্সরের জায়গায় সার্টিফিকেশন শব্দটি বসেছে। বেসিক আর কোনো বদল হয়নি কিংবা হবে বলে মনে করা ঠিক হবে না। কারণ, বাংলাদেশে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এখানে সরকারকে রক্ষণশীল হতেই হবে। কারণ এটা আমেরিকা-ফ্রান্স নয়। এটা বাংলাদেশ। তবে এক্ষেত্রে খানিকটা উন্নতি ঘটানো সম্ভব যদি বিধিমালাগুলো নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন, এভাবে বলতে হবে ‘শুধু চুম্বন অ্যালাউ’। সেটা না বলে যদি বলা হয় ‘নগ্নতা অ্যালাউ হবে না’ তাহলে বিপদ। নগ্নতা মাপবেন কিভাবে? একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। আবার যদি বলা হয় ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’, এমন বায়বীয় বিধি লেখা অর্থহীন। এখানে স্পষ্ট করে বলতে হবে, ধর্মীয় অনুভূতির মধ্যে ঠিক কী কী বিষয়, কোন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পড়ে। নাম উল্লেখ করতে হবে। এভাবে যদি প্রতিটি বিষয় যৌক্তিকভাবে স্পেসিফাই করা হয়, তাহলে একটা কিছু দাঁড়াতে পারে। দেখা যাক কী করেন নতুন বোর্ড সদস্যরা।’
নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মনে করেন, এখন যে সেন্সর নীতিমালা রয়েছে, সেটা এমনভাবে বানানো হয়েছে, যাতে যে দল ক্ষমতায় থাকবে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী যেকোনো ছবি আটকে দেওয়া যায়। তার প্রত্যাশা, ‘আমরা চাই, যে দলই সরকারে থাকুক ফিল্মমেকারদের গলা যেন কেউ চেপে ধরতে না পারে। তার বদলে একটি রেটিং সিস্টেম চালু করা উচিত, যেখানে বলে দেয়া হবে কোনটা অ্যাডাল্টদের জন্য, কোনটা প্যারেন্টাল গাইডেন্স লাগবে ইত্যাদি।’

এদিকে সেন্সর ও সার্টিফিকেশনের মধ্যে পার্থক্য জানতে চাইতেই ভারত ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন নির্মাতা অনন্য মামুন। তিনি বলেন, ‘কাগজে কলমে অবশ্যই সেন্সর থেকে সার্টিফিকেশন অনেক উত্তম একটা পদ্ধতি। যেমন দুই বছর ধরে আমার সিনেমা ‘মেকআপ’ আটকে আছে সেন্সর বোর্ডে। অনেক চেষ্টা তদবির করেছি, আপিল করেছি। আপিল বোর্ড আমাকে জানিয়েছে, ‘সিনেমাটি খুব দুর্বল নির্মাণ, দুর্বল চিত্রনাট্য, বাজে শটসহ নানা কারণেই এই ছবি প্রদর্শনের অযোগ্য।’ এই মন্তব্যটি পড়লেই স্পষ্ট হবেন, তারা আসলে নিজেরাই সিনেমাটি নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। দুর্বল নির্মাণ, চিত্রনাট্য, দৃশ্যায়ন- এগুলো তো তাদের দেখার বিষয় নয়। তারা দেখবেন ছবিটি রাষ্ট্রের বা জাতির কোনো ক্ষতির কারণ হচ্ছে কিনা।’
এদিকে এই আলাপে বোর্ড থেকে বেরিয়ে পড়া সদস্য আশফাক নিপুন এবং ভেতরে থাকা অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকে যুক্ত করতে চাইলেও তারা সাড়া দেননি। অন্যদিকে সার্টিফিকেশন বোর্ডের প্রজ্ঞাপন জারির দিন (২৩ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ওয়েবসাইটের নাম বদলায়নি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।

বলা দরকার, আওয়ামী লীগ শাসনামলে অন্তত ছয়টি আলোচিত সিনেমা আটক বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সেন্সর বোর্ড। এছাড়া কাঁচির নিচে পড়েছিল অসংখ্য ছবি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ছয়টি ছবি না আটকালে ১৫ বছরে এমন আরও ৫০টি সিনেমা নির্মাণ হতো দেশে। যেগুলোর মধ্য দিয়ে ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ প্রতিষ্ঠা পেত, সমৃদ্ধ হতো চলচ্চিত্র শিল্প। এ তালিকায় রয়েছে এনামুল করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’, নজরুল ইসলাম খানের ‘রানা প্লাজা’, অং রাখাইনের ‘আমার বাইসাইকেল-মর থেংগারি’, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’, অনন্য মামুনের ‘মেকআপ’ এবং রায়হান রাফীর ‘অমীমাংসিত’। প্রতিটি ছবি ইতিহাস, বাংলাদেশ, চিত্রনাট্য ও নির্মাতা বিবেচনায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেন্সর বোর্ড হিমাগারেই রেখে দিলো এগুলো!


আরো সংবাদ



premium cement

সকল