২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বিশেষজ্ঞদের অভিমত

কারচুপি চ্যালেঞ্জের সুযোগ নেই ইভিএমে  

কারচুপি চ্যালেঞ্জের সুযোগ নেই ইভিএমে   - ছবি : সংগৃহীত

শত আপত্তি ও তুমুল বিতর্কের মুখে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণে ইলেকট্র্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হচ্ছে। বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না এই ভোটিং যন্ত্রের ব্যবহার। এক দিকে এই যন্ত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করা ভোটের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি সাধারণ ভোটারের আস্থাও অর্জন করা যাচ্ছে না। ভোট দেয়ার পর ব্যালট পেপার প্রিন্ট করার সুযোগ না থাকায় ভোটার তার ভোট কোথায় গেছে তা নিশ্চিত হতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল। তাদের মতে, ভোটারদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইসির উচিত ছিল এই ইভিএমের সাথে পিন্ট ট্রে রাখা, যাতে করে প্রযুক্তিতে ভোট দিয়েও ভোটার দেখতে পারে কোথায় তার ভোট পড়েছে। আর এই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ইসির আলোচনা করা উচিত ছিল। এ ছাড়া কন্ট্রোল ইউনিট যে চিপ প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে যুক্ত করা হবে সেটি প্রোগ্রামিং করার সময় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতি রাখা প্রয়োজন। তাহলে কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্যতা আসত।

বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী, ইভিএম পদ্ধতি প্রথম চালু হয় যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ সালে। পৃথিবীর শতকরা ৯০ ভাগ দেশে ই-ভোটিং পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ এটি চালু করেছিল, তারাও এখন এটি নিষিদ্ধ করছে। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল কোর্ট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট ইভিএমে সম্পন্ন তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে। আমেরিকার ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও তা নিষিদ্ধ হওয়ার পথে। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের দ্বারা কেন্দ্র দখলের পর পোলিং এজেন্টদের নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে সর্বাধিকসংখ্যক ভোটের মালিক হতে পারে প্রভাবশালী মহল।
এ দিকে, জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার নিজেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সভায় বলেছেন, ইভিএম নিয়ে ভোটারদের মনে আছে ভীতি। এ ছাড়া ইভিএমে জাল ভোট প্রদান প্রতিহত করা এক বিরাট সমস্যা। বুথ দখল করে বা গোপন কক্ষে গিয়ে জাল ভোট প্রদান অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের সম্মিলিতভাবে গোপন কক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক। বর্তমান সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার কমিশনের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে আগে আমি ক্রিটিক্যাল থাকলেও দু’টি কারণে এখন ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। একটি হচ্ছে, এতে ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে বাক্স ভর্তি করার সংস্কৃতির অবসান ঘটতে পারে। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, নির্বাচনে কোনো কোনো কেন্দ্রে শতকরা এক শত ভাগ ভোট পড়ার যে অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি, ইভিএম ব্যবহারে তারও অবসান হবে।

সাখাওয়াত হোসেন : সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) সাখাওয়াত হোসেনের মতে, কেন্দ্র ও বুথ দখল হলে কোনোটাই কাজ করবে না। ইভিএমে রাতে ভোট করা যাবে না। কিন্তু ব্যালটে তো রাতেই বাক্স ভর্তি করা সম্ভব। তাই সবার আগে প্রয়োজন বুথ ও কেন্দ্রের প্রটেকশন নিশ্চিত করা। সমস্যা হলো, বেড়ায় যদি ক্ষেত খায় তাহলে কী করবেন। তিনি বলেন, আমাদের আজ হোক কাল হোক প্রযুক্তিতে যেতে হবে। তাই ইভিএমকে গ্রহণীয় করতে কিভাবে পরিবর্তন আনা যায় সেটির ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ইসির সাথে আলোচনা করা। মানুষকে সচেতন করতে না পারলে কাজ হবে না। পাশাপাশি ইসির উচিত ছিল প্রোগ্রামিং করার সময় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে রাখা। তিনি বলেন, ইভিএম ভালো। নেটের সাথে এর কোনো সংযোগ নেই। বাইরে থেকে হ্যাক করার সুযোগ নেই। তবে এখানে সমস্যা হলো চ্যালেঞ্জ করার সেই সুযোগটা নেই। এখানে প্রিন্ট ট্রে যুক্ত করার ব্যাপারে আলোচনা করা দরকার। ইভিএমে ভোটের পর তার ব্যালট পেপারটি প্রিন্ট করার জন্য ট্রে যুক্ত করা যেতে পারে। এতে করে ভোটারের তুষ্টি আসবে।

রিয়াজুল ইসলাম রিজু : ইভিএম বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজুর মতে, ইভিএম যন্ত্র মানুষ তৈরি করেছে। এটার মধ্যে যেভাবে প্রোগ্রামিং করে দেয়া হবে সেভাবেই চলবে এটা। সেভাবেই হবে ভোট। সকালে শুরুর প্রথম ঘণ্টায় সঠিক ভোট পড়লেও পরের ঘণ্টায় তার ঠিক থাকবে না। এখানে ফলাফল ম্যানুপুলেশন করা সম্ভব। ইসি বাড়তি চাপে আছে। নির্বাচনী কর্মকর্তাকে ইভিএমে ২৫ শতাংশ ভোট দেয়ার ক্ষমতা আছে। এটা সে কত শতাংশ দিয়েছে তা বের করার কোনো সুযোগ নেই। চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ইসি মো: রফিকুল ইসলাম সম্প্রতি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে বলেছেন, আপনারাই কেন্দ্রের রাজা। তার কথাতেই সব পরিষ্কার। ২৫ শতাংশ ভোটের ক্ষমতা ওই সব কর্মকর্তার হাতে ইসি দিয়েছে।
প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, এখানে একটি কন্ট্রোল ইউনিট থাকে। এটা থাকে এজেন্ট ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার রুমে। আর ব্যালট ইউনিটটি থাকে অন্য রুম বা গোপন কক্ষে। ব্যালটের জন্য একজন ভোটার যখন কন্ট্রোল ইউনিটের নির্দিষ্ট অংশে চাপ দেবে তখন কন্ট্রোল ইউনিটটি ওপেন হয়ে যাবে। ব্যালট ইউনিটে ব্যালট পেপার চলে আসবে। মেশিনেও ভুল হতে পারে। তিনি বলেন, ভারতে এই ইভিএমে ভোট দেয়ার পর ভোটারের কাছে পেপার বের হয়ে আসে। এখানে সেই সিষ্টেম করা হয়নি, যার কারণে এখানে চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই। আদালতেও যাওয়ার সুযোগ নেই। যেটা ব্যালটের নির্বাচনে সুযোগ আছে।

প্রযুুক্তিবিদ রিয়াজুল বলেন, আমরা প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নয়। তবে যারা এই মেশিনের পেছনে আছেন তাদের ওপর কারো কোনো আস্থা ও বিশ্বাস নেই। ইভিএম থেকে বিশ্বের অনেক দেশ সরে এসেছে। জার্মানি তাদের মধ্যে অন্যতম।

মুনিরা খান : নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেমা’র চেয়ারপারসন মুনিরা খান বলেন, প্রযুক্তি আমরা অবশ্যই চাইব। তবে তা হতে হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। ইভিএমে ভোটারদের সন্তুষ্টি নেই। তিনি বলেন, ভোটার তার কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছে কি না তা নিজের চোখে দেখে বুথ থেকে আত্মতুষ্টি নিয়ে বের হতে চায়; কিন্তু ইভিএমে সেই সুযোগটা নেই। কারণ এখানে প্রিন্ট অপশন নেই। ফলে ভোটের ফলাফল নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগও নেই। তিনি বলেন, এই ইভিএমে ভোট প্রদান পদ্ধতি অনেক উন্নত দেশে বন্ধ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, সবার আগে যেটা দরকার তা হলো ভোটার ও অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা। ভোটারদের ও প্রার্থীদের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে পদ্ধতির ওপর। আর এটা আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। তিনি বলেন, এই মেশিনের ওপর আস্থা অর্জন করাতে হবে। ভোট দেয়ার পর ভোটারের নিজের সন্তুষ্টিই থাকছে না ইভিএমে। ভোটার জানতে পারছে না তার দেয়া ভোট কোথায় পড়ল। তিনি বলেন, সিইসি বলেছিলেন সিটি নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে কোনো পক্ষের আপত্তি থাকলে তা ব্যবহার করা হবে না; কিন্তু অনেকেই এটা চাচ্ছে না, তারপরও ব্যবহার করা হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement