২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
রাষ্ট্রীয় মদদে গুম সংস্কৃতির অবসান

সামনে তদন্ত ও বিচারকাজ

-

 


অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করায় বাংলাদেশ এক নতুন যাত্রা শুরু করল। ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবসের আগের দিন এ সনদে স্বাক্ষর করে অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বের কাছে এ বার্তা দিলো যে, আগামীর বাংলাদেশ হবে মানবিক।
গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত একটি বুনো শাসনে ছিলাম আমরা। যেখানে মানুষের প্রাণের কোনো মর্যাদা ছিল না। ফ্যাসিস্ট হাসিনা যাকে খুশি খুন এবং গুপ্ত কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করেন। গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলোর কান্না, দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন ও জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের উপর্যুপরি আবেদন সত্ত্বেও হাসিনাকে এমন মানবতাবিরোধী কাজ থেকে বিরত রাখা যায়নি। শত শত মানুষের গুম হওয়াকে শুধু অস্বীকার করার নীতি দিয়ে মোকাবেলা করেছেন হাসিনা।

গুমবিরোধী সনদটি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ৩২টি দেশ অনুস্বাক্ষরের পর ২০১০ থেকে বাস্তবায়ন শুরু হয়। আশা করা হচ্ছে, এখন থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও গুমের ঘটনা থেকে সরকার বিরত হবে। তবে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনার একটি সুরাহার চ্যালেঞ্জিং কাজটি সরকারের সামনে রয়ে গেল। কারণ, হাসিনা দেশের প্রচলিত প্রত্যেকটি বাহিনী দিয়ে গুম-খুনের কাজ করিয়েছেন। খুনে বাহিনী গঠনে এক ঘৃণ্য নজির স্থাপন করেছেন। এ কাজে নতুন নতুন সদস্য নিয়োগ করে পুরো বাহিনীকে কলুষিত করার কাজটি চালিয়ে গেছেন। প্রচলিত প্রতিটি বাহিনীতে তিনি এসব খুনিকে মিশিয়ে দিয়েছেন। র্যাব সোয়াতসহ বিশেষায়িত বাহিনীকে তিনি এ কাজে ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া নিজ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকদেরও ওইসব খুনি বাহিনীর সাথে মিশিয়ে ফায়দা নিয়েছেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার আনুকূল্যে সৃষ্টি করেন আয়নাঘর। গুমের শিকার ব্যক্তিদের বর্ণনায় পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার আওতায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ চলছিল। বন্দী অবস্থায় তাদের যেসব ওষুধ, খাবার, বই ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দেয়া হতো তাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের লোগো ও লেখা দেখা যেত। পাহারা দিতে নিয়োজিত ব্যক্তি, চিকিৎসক, নরসুন্দর ও খাবার সরবরাহকারীদের আচরণে এটা স্পষ্ট প্রকাশিত ছিল তারা সশস্ত্রবাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোক। এটা নিশ্চিত যে, হাসিনা সরকারি সিস্টেমকে এ নিন্দনীয় কাজে ওতপ্রোত জড়িয়ে নিয়েছিলেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশ, ২০০৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৬২৯ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে। অপহরণের পর ৫৯ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যারা কেউ আর পরে মুখ খোলেননি। গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৭৩ জনকে। মায়ের ডাকের হিসাবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৫৮ জন। সরকার ইতোমধ্যে গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছে। বিগত সরকারের সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে ৪৫ দিনের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। আশা করা যাচ্ছে, বিভিন্ন বাহিনী থেকে এ জঘন্য কাজে যারা জড়িত; এমনকি যারা এ কাজে সহযোগিতা করতে সরকারের বাইরে থেকে সহযোগী হয়েছেন সবাইকে শনাক্ত করতে পারবে এ কমিশন।
৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ অনেকটাই ধ্বংসস্তূপ। সামরিক বাহিনী ছাড়া আইনশৃঙ্খলায় নিযুক্ত প্রতিটি বাহিনী অকার্যকর হয়ে যায়। এখনো এসব বাহিনীকে পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় করা যায়নি। হাসিনা সব বাহিনীকে পোষ্য বানাতে গিয়ে জনগণের শত্রুতে পরিণত করায় এই করুণ হাল। তাই গুম খুনের বিস্তৃত তদন্ত ও বিচার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির। আদৌ কাজটি সম্পন্ন করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে বিপ্লবী ছাত্রসমাজ আশা জাগাচ্ছে। এর সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও জটিল পরিস্থিতিতে সহযোগিতার মনোভাব দেখাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত অপরাধ তদন্ত ও বিচারে জাতিসঙ্ঘ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আশা, অচিরেই বাংলাদেশ এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবে।


আরো সংবাদ



premium cement