২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে উদ্বেগ

কার্যকর পদক্ষেপ নেই কেন

-

ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট হওয়ায় দেশের আর্থিক খাত যে ফোকলা হয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংক দুর্নীতিবাজ চক্রের থাবার বাইরে থাকতে পারেনি। কিছু ব্যাংককে সুরক্ষিত মনে হলেও শেষ পর্যন্ত সেগুলোও লুটপাটের শিকার হয়েছে। এ সংক্রান্ত খবরাখবর এখন প্রকাশ্যে এসে যাচ্ছে। শুরুতে তহবিল হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা যদি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেত তাহলে হয়তো বা কিছু চুরির ঘটনা রোধ করা যেত। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে। সরকার এসব তহবিল হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা স্বীকার করেনি, স্বীকার করলেও খাটো করে দেখিয়েছে। পরিণতিতে বিগত ১০ বছরে নজিরবিহীন লুটপাটের সুযোগ পেয়েছে একটি গোষ্ঠী। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে বক্তারা বলেছেন, ব্রিটিশ আমলেও ব্যাংক থেকে এত লুটপাট হয়নি।
ব্যাংক খাত নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে এমন নজিরবিহীন লুটপাট কিভাবে সম্ভব হয়েছে তা উঠে আসছে। বর্তমান সরকার প্রথম ক্ষমতায় আসার পর এর শুরু। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর এ কেলেঙ্কারির সূচনা হয়। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয় মূলত সরকারদলীয় লোকজনকে সুযোগ করে দেয়ার লক্ষ্যে। এরা হচ্ছেন দলের মধ্যে থাকা সেসব লোক যারা বঞ্চনা অনুভব করেছেন। সরকার তাদের এর মাধ্যমে সুবিধা দিতে চাইছিল। কিছু দিনের মধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। কারণ দলের দ্বিতীয়-তৃতীয় সারির নেতারা বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বাছবিচারহীনভাবে নিয়োগ পান। এমনকি সরকারঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের লোকজনও সুযোগ নিতে পিছপা হননি।
শুরুতে অর্থ লোপাট করে নেয়া ব্যক্তিরা বিচারের আওতায় আসেননি; বরং এসব লোক সমাজে প্রভাবশালী হিসেবে নিজেকে জাহিরের সুযোগ পেয়েছেন। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের মূল হোতার এখনো কিছুই হয়নি। এ ধরনের অর্থ আত্মসাৎ বিগত এক দশক ধরে অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংক ছাড়িয়ে বড় বড় অর্থ সরিয়ে নেয়ার ঘটনা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও সমানে ঘটতে থাকে। এ ক্ষেত্রে পি কে হালদারের নাম বলা যায়। তার ব্যাপারে বলা হচ্ছে- ১০ হাজার কোটি টাকা একাই হাতিয়ে নিয়েছেন। তার থাবার শিকার হয়েছে লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলো।
অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ কত সেটি অনুমান করা যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। পর্যবেক্ষকদের অনেকে দাবি করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিক হিসাব দিচ্ছে না। খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা। কারো মতে, এটি আরো বেশি হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে মোট ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ কোটি টাকা। এ অর্থ নিয়ে লুটেরারা কী করছে তারও উত্তর পাওয়া যায়। এক দশক ধরে মুদ্রাপাচারের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ব্যাংক ছাড়াও সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নেয়া দুর্নীতির বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের অর্থ কিভাবে দুর্নীতিবাজরা নিয়ে যেতে পারছে! সরকার না হয় রাজনৈতিক কারণে ঘনিষ্ঠদের ছাড় দিচ্ছে; কিন্তু দেশের ভেতরের রক্ষাকবজগুলো কি একেবারে অকেজো হয়ে গেছে? এখন সে আশঙ্কা জেগে উঠছে। দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধব্যবস্থা নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে বড় ধরনের অর্থ বেরিয়া যাওয়ার পর প্রথমবারের মতো দেখা গেল, উচ্চ আদালত এ নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এর কার্যকারিতা কতটুকু? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি কোথায় গেল? দুর্নীতি দমন কমিশন কেন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? বাংলাদেশের আর্থিক-ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ এখনো কার্যকরভাবে কোথাও থেকে দেখা যাচ্ছে না।


আরো সংবাদ



premium cement