২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
আবারো বিজয় দিবস ফিরে এসেছে

স্বাধীনতার প্রকৃত বাস্তবায়ন কতটুকু হলো

-

আজ ১৬ ডিসেম্বর, আমরা ৫২তম বিজয় দিবস উৎযাপন করছি। জাতি আজ এক সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে যা আমরা জোর গলায় দাবি করি সেগুলো অর্জিত হয়েছে কি না সে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা যেন পেছনের দিকে হেঁটেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা যেন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছি। একটি জাতির ইতিহাসে এটি কম সময় নয়। অর্ধ শতাব্দীকালে আমাদের সাথে আরো কিছু দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেগুলোর অনেকে আজ উন্নত সমৃদ্ধ মানবিক সমাজ কায়েম করেছে। অথচ ওইসব দেশ কোনো দিক দিয়ে আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল না। এ অবস্থায় দিনটিকে গতানুগতিক গালভরা বুলি নিয়ে আয়োজনের চেয়ে বড় প্রয়োজন চেতনার সত্যিকার বাস্তবায়ন নিয়ে মূল্যায়নে নামা। আমাদের বড় বড় ঘাটতির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা; অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া। এ ছাড়া আমাদের জাতীয় মুক্তি অর্জিত হওয়া আগের মতোই সুদূরে থেকে যাবে।


পাকিস্তানিরা আমাদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেছিল। আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রধান কারণ হয়েছিল এটি। মানুষের বিপুল সমর্থনকে উপেক্ষা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভোটের মর্যাদাকে তারা লুণ্ঠিত করেছিল। তারা ছিল বিজাতীয় একদল শাসক। অথচ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পরও আমরা একই বৃত্তে খাবি খাচ্ছি। আমাদের দেশে বিনাভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়ে নিশিরাতে ভোট হয়ে যাচ্ছে। এক কথায়, এখন মানুষের ভোটাধিকার নেই। এই অধিকার আমরা নিজেরাই লুণ্ঠন করছি, বাইরের কেউ নয়। এ অবস্থায় আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম। চেপে বসা কর্তৃত্ববাদী শাসনে নাগরিকদের মৌলিক ও মানবাধিকারের আকুতি শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিকানা থেকে জনগণকে উচ্ছেদ করার কারণে। এ অবস্থা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।


রাজনৈতিক নিপীড়ন দেশে চরম আকার ধারণ করেছে। বিরোধীরা অবাধে সভা-সমাবেশ করতে পারছে না। বিরোধীদের সমাবেশ হামলা চালিয়ে পণ্ড করে দেয়া হচ্ছে। পুলিশের বুলেটের আঘাতে, সরকারি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দুর্বৃত্তদের হামলায় বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকরা প্রাণ হারাচ্ছেন। প্রধান বিরোধী দলের অফিসে অভিযান চালিয়ে ভাঙচুর করা হচ্ছে। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে শীর্ষ নেতাদের আটক করা হচ্ছে সমানে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জাতি দিশেহারা অবস্থায় রয়েছে। মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এ ক্ষেত্রে এখন আলোর কোনো দিশা দেখা যাচ্ছে না। এক কথায় বলা যায়, জাতি যেন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে পারছে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অকার্যকর। মানবাধিকার নিয়ে সমালোচনা বিদ্যমান।
মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্যমুক্ত-শোষণমুক্ত স্বদেশ, যে বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমুন্নত। পাঁচ দশকে আমাদের আর্থসামাজিক খাতে ধীরে হলেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। উন্নয়নের কিছু সূচক বৈশ্বিক নজর কেড়েছে। দেশবাসীর জীবনমানে পরিবর্তন এসেছে। দেশব্যাপী অবকাঠামো উন্নয়ন চোখে পড়ছে। শহরে শহরে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বী অট্টালিকা। গ্রাম-শহরে জীবনযাত্রার বৈষম্য বিপুল। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আরো প্রকট। এ ব্যবধান ঘোচানোর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এখনো দেশে দারিদ্র্যসীমায় পাঁচ কোটির বেশি লোকের বাস। অর্থনীতির আকার বেড়েছে; কিন্তু সম্পদের বণ্টন ন্যায্যতাভিত্তিক নয়। বেশির ভাগ সম্পদ গুটিকয় ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে কুক্ষিগত। দুর্নীতি বেড়েছে মহামারী আকারে। বিচার ও সুশাসনের অবস্থা নড়বড়ে।
স্বাধীনতাকামী মানুষ একটি চেতনা নিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই চেতনার যথাযথ মূল্যায়ন হতে হবে। আমরা দেখছি, প্রায় একই সময় পাড়ি দিয়ে অনেক দেশই উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। নির্মাণ করেছে বিকশিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সমৃদ্ধ একটি দেশ প্রতিষ্ঠা আমাদের পক্ষেও সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বক্তৃতা-বিবৃতিতে আটকে না রেখে বাস্তবে চর্চার মাধ্যমেই সেটি সম্ভব। সে জন্য দরকার জাতীয় ঐকমত্য। ভেঙে ফেলতে হবে বিভেদের সব দেয়াল। তৈরি করতে হবে সাম্য। টেকসই গণতন্ত্র ও উন্নয়ন সমান্তরালে চললে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়। এ জন্য এগোতে হবে জাতীয় সমঝোতা, সম্প্রীতি ও ঐক্যের মহাসড়কে।


আরো সংবাদ



premium cement