২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
মন্ত্রণালয়ে এক লাখ মামলা

প্রশাসনে হযবরল

-

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য এসব কথা বাংলাদেশে সরকারি প্রশাসনের ব্যাপারে বহুল ব্যবহৃত। সরকারি কাজে কমবেশি সবাই এর শিকার। এমনকি বিদেশীরা বাংলাদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে বা বেড়াতে এসে কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে এসে তিক্ত অভিজ্ঞতায় পড়েন। কোনো একটি কাজ সরকারের কাছ থেকে উদ্ধার করতে কঠিন জটিল অবস্থায় পড়তে হয়। আবার এর ফলে সময় ও শ্রমের বিপুল অপচয়ের পরও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ বিরক্ত হয়ে কর্ম উদ্ধার না করে ক্ষান্ত দেন। বিদেশীরা এর চক্করে পড়ে ব্যবসাবাণিজ্য করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বিদেশী বিনিয়োগের করুণ দশার প্রধান কারণ এটি। একটি সহযোগী দৈনিকের খবরে জানা যাচ্ছে, আমাদের আমলাতন্ত্র নিজেদের ভেতরে সৃষ্ট সমস্যাগুলোও সুরাহা করতে পারছে না। ফলে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ আপত্তি নিয়ে মামলার পাহাড় জমেছে। এ অবস্থায় একটি স্বচ্ছ গতিশীল প্রশাসন উপহার দেয়া প্রায় অসম্ভব।
পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে, সরকারের ৫৪টি মন্ত্রণালয় ও আটটি বিভাগীয় কমিশনারের বিরুদ্ধে এক লাখ ৮২৩টি মামলা ঝুলে আছে। এমন কোনো মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, পরিদফতর, সংস্থা ও বিভাগীয় কার্যালয় নেই যেখানে অমীমাংসিত মামলা নেই। এর মধ্যে এক হাজার ৮৯৫টি মামলাকে গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ৪৫৩টি মামলায় সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে রিট রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ১৭ হাজার ৫৭২টি মামলা রয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে। ১১ হাজার ৮১৭টি মামলা নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ছয় হাজার ৮৪৮টি মামলা নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এভাবে নিজেদের মধ্যে সঙ্কট জিইয়ে রেখে কর্মকর্তাদের জন্য প্রশাসন চালানো মুশকিল।
মামলার এই বিশাল সংখ্যা নিজেদের মধ্যে সংঘটিত নানা মাত্রার অপরাধের ফল। প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা-অনৈতিকতা কতটা গেড়ে বসেছে তা অভিযোগের মাত্রা থেকে অনুমেয়। নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ, পদোন্নতি এবং গ্রেড সিলেকশনে স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি হচ্ছে। একজন অন্যজনকে হয়রানি করছেন, অপমান করছেন, নির্যাতন চালাচ্ছেন। রয়েছে নারীর শ্লীলতাহানি ও নির্যাতনের মতো নিষ্পত্তি না হওয়া অপরাধের ঘটনাও। এগুলো করতে গিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অবাধে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। খবরে জানা যাচ্ছে, অপরাধের অভিযোগের নিষ্পত্তি না হলেও এ নিয়ে সরকারি কোষাগার থেকে নিয়মিত অর্থ ব্যয় হচ্ছে। অর্থাৎ নিজেদের অপরাধ নিষ্পত্তি নিয়ে অর্থ নয়ছয় চলছে। সর্বশেষ খবর হচ্ছে- প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে অভিযোগের জট নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১০ নভেম্বর এ ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের একটি জরুরি সভা ডেকেছে। বর্তমান সরকারের সময়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা নানা ধরনের অপরাধ করে পার পাওয়ার নজির সৃষ্টি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের গুরুতর অপরাধে লঘুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আবার রাষ্ট্রপতির পদবি ব্যবহার করে সেসব লঘুদণ্ড বাতিল করার উদাহরণও দেখা গেছে। এ অবস্থায় বর্তমান সরকারের সময়ে প্রশাসনের ভেতরে যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে সেটি পরিষ্কার হবে তা আশা করা যায় না।
রাস্তায় একটি দেয়াল লিখন দেখা গেছে দীর্ঘ দিন। তাতে বুঝানো হয়েছে- টেবিলে ফাইল আটকা রেখে ঘুষ আদায় আর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ছিনতাই চাঁদাবাজি একই মাত্রার অপরাধ। একে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নাম দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এ অভ্যাস আগের মতো রয়ে গেছে। তার সাথে নানা নিয়ম-কানুনের দোহাই দিয়ে জটিলতা তৈরি করে তাদের স্বার্থসিদ্ধির ঘটনাও বহালতবিয়তে আছে। তবে আমাদের প্রশাসনের অভ্যন্তরে নিজেদের মধ্যেও যে এমন বিরোধ বঞ্চনা ও অভিযোগের পাহাড় অনিষ্পন্ন রয়েছে সেটিও এর চেয়ে কম ভয়াবহ নয়; তা পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যাচ্ছে। একটি উন্নত সৎ স্বচ্ছ জাতি বিনির্মাণে আমলাতন্ত্র কলুষতামুক্ত করা দরকার। প্রথমে তাদের নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট অনিয়ম অপরাধের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি অভিযোগের সুরাহা হতে হবে স্বচ্ছভাবে। তারপর লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও মাথাভারী প্রশাসনের জটিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে আমরা পাবো একটি গতিশীল প্রশাসন।


আরো সংবাদ



premium cement