২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
রাজধানীতে গণপরিবহনে নৈরাজ্য

নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর নেই

-

গত এক বছরে দুই দফা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর গণপরিবহনে অস্বাভাবিক হারে ভাড়ানৈরাজ্য শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করে ভাড়ানৈরাজ্য থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, যেহেতু রাজধানীসহ সারা দেশের গণপরিবহন খাত সরকার সমর্থক মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা অন্যায় হবে না, সরকার গোষ্ঠীস্বার্থে গণপরিবহনে ভাড়ানৈরাজ্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না বা নিতে পারে না। তাই দেখা যাচ্ছে- কোনো কোনো পরিবহনে দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অবস্থা এতটা নাজুক যে, অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার বিষয়ে প্রতিবাদ করলে যাত্রীরা হেনস্তা, অপমান ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এতে করে অস্থির হয়ে উঠেছে গণপরিবহন খাত।
জাইকার সমীক্ষানুযায়ী, ঢাকায় বিভিন্ন শ্রেণীর গণপরিবহনে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন কোটি ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হয়। এ হিসাব ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় জানানো হয়, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চলছে।
বর্তমানে নগরীর কোনো পরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর নেই। ফলে ভাড়া আদায়ে অরাজকতা দিন দিন বাড়ছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে- গত এক বছরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় তর্কের জেরে গণপরিবহনগুলোতে ২৫টি যাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। এতে বাস থেকে ফেলে ১৪ যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। গুরুতর আহত হন ১০ যাত্রী। এতে গণপরিবহন ব্যবহারে যাত্রীসাধারণের মাঝে ভীতি সঞ্চার হয়।
সংশ্লিøষ্ট সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, ১৫ হাজার বৈধ অটোরিকশার পাশাপাশি আরো ১৫ হাজার অবৈধ অটোরিকশা ঢাকা ও আশপাশের জেলায় চলাচল করে। ৩০ হাজার অটোরিকশা দৈনিক গড়ে ১২টি হিসাবে তিন লাখ ৬০ হাজার ট্রিপ যাত্রী বহন করে। এসব অটোরিকশায় প্রতি ট্রিপে গড়ে ১৪৫ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। এতে দৈনিক তিন লাখ ৬০ হাজার ট্রিপ যাত্রীকে কেবল অটোরিকশা খাতে বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে পাঁচ কোটি ২২ লাখ টাকা।
রাজধানীর ৫০০০ বাস-মিনিবাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ লাখ ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হয়। এসব সিটি সার্ভিসের শতভাগ বাসে সরকারনির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। এসব বাস-মিনিবাসে যাতায়াতে যাত্রীপ্রতি মাথাপিছু গড়ে ১৭ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে হয়। এতে ৫০ লাখ ট্রিপ যাত্রীর দৈনিক গড়ে সাড়ে ৮ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে।
৪০ হাজার হিউম্যান হলার রাজধানীতে দৈনিক গড়ে ৮০ লাখ ট্রিপ যাত্রী বহন করে। প্রতি ট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে আট টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হন। এতে ছয় কোটি ৪০ লাখ টাকা হিউম্যান হলারের যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। হিউম্যান হলারের ভাড়া নির্ধারণের আইন থাকলেও সরকার নির্ধারণ না করায় এখানে বরাবরই দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বাড়তি ভাড়ায় যাতায়াত করতে হচ্ছে যাত্রীদের। পাঁচ লাখ রাইডশেয়ারিং মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, ট্যাক্সিক্যাবে দৈনিক গড়ে দুই কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার ট্রিপ যাত্রী বহন করছে। এগুলোতে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৭৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এসব যানবাহনে দিনে গড়ে ১৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে।
গণপরিবহনে এমন ভাড়া নৈরাজ্যে সামাজিক অস্থিরতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। পরিবহনব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সব ধরনের পণ্যমূল্য বেড়েছে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দিন দিন সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। সঙ্গত কারণে শক্ত হাতে ভাড়ানৈরাজ্য রোধে দ্রুততম সময়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গোষ্ঠীস্বার্থ পরিহার করা আবশ্যক। কিন্তু সরকারি লোকজনের দিকে তাকালে আশাহত হতে হয়। কারণ, জনগণের স্বার্থ রক্ষায় শাসকগোষ্ঠী গুরুত্ব দেয় বলে মনে হয় না। জবাবদিহিতা না থাকলে এমন পরিস্থিতি হওয়াই স্বাভাবিক। তার পরও সবার মতো আমরা আশা করতে চাই, সার্বিক কল্যাণে অন্তত ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে উদ্যোগ নেবে সরকার।


আরো সংবাদ



premium cement