২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বৈশ্বিক খাদ্যসঙ্কটের ঝুঁকি

মানবতায় দরকার মৈত্রী

-

সমকালীন মানুষ নিজেদের সবচেয়ে সভ্য দাবি করে থাকে। অহঙ্কারের জায়গাটা হচ্ছে- মসৃণ একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে পারা, এর আগে যা কখনো এভাবে সফলতা পায়নি। এতে করে মানবজাতির সদস্য হিসেবে সব মানুষ ন্যূনতম মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে। খাদ্য, চিকিৎসা ও বস্ত্রের জোগান সবাই কিছুটা হলেও পায়। বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা নিজে থেকে কার্যকর। এ সময়ের মানুষ মনে করে তাদের মানবিক মূল্যবোধের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু অতীতের মানবগোষ্ঠী থেকে অধিকতর সংস্কৃতিবান মনে করার ধারণাটি যে সর্বৈভ ভুল বৈশ্বিক সঙ্কটকালে তা স্পষ্ট। বর্তমান সময়ের মানুষের মধ্যেও বিদ্বেষ ও আধিপত্য বিস্তারের মানবীয় দুর্বলতা প্রবলভাবে উপস্থিত। এর নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধ-বিগ্রহ। পরবর্তীতে দেখা দিচ্ছে ক্ষুধার জ্বালা।
জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানাচ্ছে, সামনে খাদ্য পাওয়ার নিরাপত্তা থাকছে না ৩৪ কোটির বেশি মানুষের। করোনা মহামারীর আগে বিশ্বব্যাপী এমন মানুষের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি। এখন এক কোটি ৩০ লাখ মানুষকে বার্ষিক খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে ডব্লিউএফপি। সংস্থাটির সরবরাহ করা খাদ্যে একজন মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার অর্ধেক পূরণ হয়। প্রতিষ্ঠানটি জানাচ্ছে, এখন এক কোটি ৬০ লাখ মানুষের খাদ্যসহায়তার প্রয়োজন। তহবিল সঙ্কটে বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন ও আফগানিস্তানের মতো দেশে বাড়তি খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন। অন্য দিকে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা মূলত বিপুল খাদ্যআমদানির ওপর নির্ভরশীল। অথচ রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন বৈশ্বিক খাদ্যসরবরাহ ব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। শস্যভাণ্ডার খ্যাত এ অঞ্চলে সরবরাহপথ যুদ্ধে বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের প্রধান শস্য সরবরাহকারী বন্দরগুলো রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তুরস্ক ও জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি হলেও এই সরবরাহব্যবস্থাকে এখনো পূর্ণ সচল করা যায়নি। এ নিশ্চয়তাও পাওয়া যাচ্ছে না যে; এ অঞ্চলের খাদ্য ভবিষ্যতে নির্বিঘেœ সরবরাহ করা যাবে।
ডব্লিউএফপি বিপুল খাদ্যঘাটতির যে আশঙ্কার পূর্বাভাস দিচ্ছে, তাতে তিনটি কারণ স্পষ্ট। করোনা মহামারীর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও অন্য দু’টির সাথে মানুষের ইচ্ছা ও বাসনার সম্পর্ক রয়েছে। ভবিষ্যতে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো আরো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে কি না; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব যদি বড় যুদ্ধে মোড় নেয়; তা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাবে। যদি সেটি হয় পরমাণু যুদ্ধ তাহলে তা হবে আরো ভয়াবহ। একদিকে পরমাণু বোমার আঘাতে বেশুমার মানুষ মারা যাবে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেয়ে আরো মানুষ প্রাণ হারাবে। চাইলে এ ধরনের ভয়াবহ যুদ্ধ পরাশক্তিগুলো এড়াতে পারে। নিজেদের মধ্যে আস্থা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক নির্মাণের পথে হাঁটতে পারে। তবে বাস্তবতা এর বিপরীত কথাই বলছে। খাদ্যঘাটতির অন্য কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এ ব্যাপারে বৈশ্বিক ফোরামে বহু আলোচনা হয়েছে। সবাই এ বিষয়ে একমত যে, শক্তিধর দেশগুলো চাইলে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে পারে। এখন পর্যন্ত বড় শক্তিগুলো তার বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। এ সংক্রান্ত বিপদ তাই প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
বর্তমান জমানার মানুষ সভ্য হওয়ার যে অহঙ্কার করে, তা যে অন্তঃসারশূন্য বৈশ্বিক চরম অস্থিরতাই এর প্রমাণ। একটি নিরাপদ বিশ্ব চাইলে মানবতার জন্য হুমকি তৈরি করে এমন আচরণ থেকে শক্তিশালী দেশগুলোকে সরে আসতে হবে। বিশেষ করে যুদ্ধ মোকাবেলায় একটি ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পরাশক্তিগুলোর এক কাতারে এসে দৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে। এরপর সবাই মিলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি শিথিলের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। এ জন্য মানুষের হাতে সময় নেই। স্বল্প সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া না গেলে খাদ্যঘাটতিতে মানুষকে ক্ষুধার জ্বালায় প্রাণ দিতে হবে। সত্যিকার মানবতার জন্য তাই দরকার মৈত্রী।


আরো সংবাদ



premium cement