২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
পাচারের অর্থ বৈধ করার সুযোগ

এই উদ্যোগের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ

-

২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফেরানোর উদ্যোগ হিসেবে কর দিয়ে স্বদেশে আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ সুযোগ নিয়ে সরকারি ঘরানা ছাড়া অন্যান্য অর্থনীতিবিদসহ সব মহলে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা এই উদ্যোগকে স্বাগত না জানিয়ে অগ্রহণযোগ্য বলছেন।
তবে এর পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হয়েছে। আর এ কারণেই তা ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ এমন উদ্যোগ নিয়ে সফলও হয়েছে। এসব অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বাধা না হওয়ার আহ্বান জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, সবদিক বিবেচনা করেই এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। শুধু ঘুষ ও দুর্নীতির টাকা নয়, সিস্টেমের কারণেও অনেক টাকা অপ্রদর্শিত হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, পাচারের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না- কারণ টাকাগুলো বিভিন্ন কারণে বিদেশে চলে যেতে পারে। সব টাকা কালো নয়। কিছু টাকা বিভিন্ন কারণেই কালো হয়ে যায়। এসব দিক বিবেচনা করেই এবার এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে করে যারা কর দিচ্ছেন তাদের সম্মান ক্ষুণœ হবে না।
অন্য দিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক- তিনভাবেই অগ্রহণযোগ্য। সংস্থাটি বলছে, এভাবে পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার বৈধতা দিলে যারা নিয়মিত কর দেন, তারা হতাশ হবেন। যারা সৎভাবে ব্যবসা করছেন, তারাও কর দিতে নিরুৎসাহিত হবেন। এমনকি দেশের টাকা এখন উল্টো বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
লক্ষণীয়, এর আগেও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল; কিন্তু খুব কমসংখ্যকই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন। যারা দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে গেছেন বিদেশে, এবার সেসব পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার বৈধতা দেয়া হচ্ছে। অথচ এসব টাকা আদায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। প্রত্যেকে দেশের আইন ভঙ্গ করে বিদেশে টাকা নিয়ে গেছেন। সঙ্গত কারণে, পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ শুধু সুযোগই নয়, দায়মুক্তিরও সুযোগ। অথচ ঋণ ও কর খেলাপি রোধে কঠোর কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হলো না বাজেটে। প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপের কথারও উল্লেখ নেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) মতে, বিনা প্রশ্নে পাচার করা অর্থ দেশে আনার সুযোগ দেয়া অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও বিদ্যমান আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। এ প্রস্তাব বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, অর্থমন্ত্রী যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, নামমাত্র কর দিয়ে প্রশ্নহীনভাবে পাচারকৃত অর্থ বিদেশ থেকে আনার সুযোগ স্পষ্টতই পাচারকারীদের অনৈতিক সুরক্ষা ও পুরস্কার প্রদান। এই সুযোগ সার্বিকভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে, যা সংবিধানপরিপন্থী। অন্য দিকে যারা বৈধ উপার্জননির্ভর করদাতা তাদের জন্য এ প্রস্তাব প্রকটভাবে বৈষম্যমূলক। কারণ তারা কমপক্ষে তিনগুণ হারে কর দিয়ে থাকেন। এটি বৈষম্য এবং সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, অবিলম্বে এ সুযোগ বাতিল করতে হবে। অর্থপাচারকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে যে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনি প্রক্রিয়া নির্ধারিত রয়েছে তা অনুসরণ করে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতো আমরাও মনে করি, বিদেশে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ দেশের অর্থনীতির মূলধারায় সংযুক্তির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ ও আয়কর রাজস্ব বৃদ্ধির যে প্রত্যাশা করা হচ্ছে; অভিজ্ঞতা বলে, বারবার সুযোগ দিয়েও দেশের অর্থনীতিতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রত্যাশিত ফল বয়ে আনেনি, সরকারও কাক্সিক্ষত রাজস্ব পায়নি। এর মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ ও অর্থপাচারকারীরাই শুধু স্বস্তি বোধ করবেন, পুলকিত হবেন। অর্থপাচারকে এভাবে বৈধতা দেয়া হলে দেশে দুর্নীতি ও অর্থপাচারে আরো বিস্তৃতি ও গভীরতা বাড়বে।

 


আরো সংবাদ



premium cement