২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলাই বিধেয়

-

মৌতলার মামুন মুনশির লেখাজোখার অভ্যাস অনেক দিনের। ফার্সি শব্দে সচিব বা হিসাব-লেখককে মুনশি আখ্যানের আদলে ওস্তাদজি মামুনকে মুনশি বলিয়া ডাকিতেন। অদ্য সকালে হঠাৎ ‘সাদা-কালো’ শিরোনামে একটি লেখা রচনার চিন্তা মুনশির মাথায় উদয় হইল। সমকালীন প্রেক্ষাপটে ইহার তাৎপর্য ও পটভূমি অবশ্য আছে। লেখাটি গদ্যে হইবে না পদ্যে হইবে, প্রবন্ধ না নিবন্ধ গল্প না নাটকে হইবে, তাহা লইয়া মাথায় নানান ধ্যানধারণার তদ্বির তল্লাশি শুরু করিয়া দিয়াছে। রচনাকারীর নাম কিভাবে লেখা হইবে ইহা লইয়াও নানান চিন্তা শুরু হইয়াছে। স্বনামে কিছু করিবার সৎসাহস ও সুযোগেরা নানান কারণে ইদানীং গা ঢাকা দিয়াছে। ৬৫ পার করিয়াও এখনো তাহাকে স্বনাম বা ছদ্মনামের আশ্রয়-প্রশ্রয় লইবার চিন্তুা মাথায় লইতে হইতেছে। ছদ্মনামে দোষের কিছু নাই। পৃথিবীতে বহু মহাজন ব্যক্তিই ইহা করিয়াছেন; কিন্তু তাহাদের সেই ছদ্মনামেরও মাহাত্ম্য ও উদ্দেশ্য বিধেয় ব্যাকরণের ব্যাখ্যা বক্তব্য বিবরণী বিকৃতির বেড়াজাল ডিঙ্গাইয়া সকলের কর্ণকুহরে পৌঁছাইয়াছে। ‘সাকি’ নামের লেখক, নীলকণ্ঠ, যাযাবর, অবধুত, লুব্ধক, গাছপাথর ইহাদের পিছনে কাহারা তাহা সকলেরই জানা। ভলতেয়ার যে কারণে ছদ্মনামের আশ্রয়ে গিয়াছিলেন যাযাবর হয়তো ঠিক তাহা ভাবিয়া করেন নাই। কেহ স্বনামে প্রকাশিত হইতে লজ্জা, কেহ বা শরম, কেহ বা ভয়, কেহ বা সঙ্কোচ বোধ করেন; কেহ বা ছোট্ট নামের মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজিয়াছেন; কেহ বা হাজার কলমের প্রতীকী প্রকাশের প্রয়াস পাইয়াছেন অর্থবহ নাম ধারণের মধ্যে।
মুনশির ধারণাÑ সাদা-কালোর বিষয়টি বর্তমান সময় ও সমাজে এমন এক পর্যায়ে আসিয়াছে, যাহা উচ্চকণ্ঠ-নিচকণ্ঠের ব্যাপার নয়Ñ ইহা মূল্যবোধের জন্য একটা দড়ি টানাটানির ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বিভিন্ন রঙের বাহারে বানানো টাকাকে কালো টাকা সাব্যস্ত করিবার বিধিবিধান লইয়া টকশোতে ঝাল মিষ্টির মহরত চলিতেছে। আদি ও অকৃত্রিম রঙ সাদা-কালোকে লইয়া মাতামাতি ভালোই চলিতেছে। অথচ সাদার বিপরীতে কালোকেই তো মানায় ভালোÑ যেমন দিন ও রাত, যেমন ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎ, আনন্দ ও সর্বনাশ। একের উপস্থিতি অন্যের অনুপস্থিতিকে অনিবার্য করিয়া তোলে। হয় তুমি না হয় আমি, এই ধরনের একটি বাধাবাধির ব্যাপার আর কি! কিন্তু আমাদের যে উভয়ের দরকার। ‘খোলা আকাশ কি এত ভালো লাগত যদি কিছু কিছু মেঘ নাহি ঢাকত’। ইহা তো সন্ধ্যা মুখার্জির সুরেলা কণ্ঠের কথাÑ চাঁদে কলঙ্ক থাকিবে ইহা সাংবিধানিক সত্যের মতো ধরিয়া লওয়া যায়Ñ নিন্দার কাঁটা না বিঁধিলে নাকি প্রেমের সাধ পূর্ণ হয় না। সত্যম শিবম সুন্দরের বাগ বাগিচায় দুই একটা আগাছা কিংবা নামহীন গোত্রহীন ফুলের পদচারণা মানিয়া লওয়া যায় কি না তাহা ভাবিবার বিষয়। তবে এই ভাবাভাবির অবকাশে অগোচরে অনেক অকল্যাণ হুড়মুড় করিয়া ঢুকিয়া যে শ্বেত শুভ্র রজনীগন্ধার গায়ে অসংখ্য অসময়ের রেণু স্পর্শ করিতেছে সকাল-বিকাল, তাহার খোঁজখবর বনমালীর নাই। রাখিবার ফুরসতও মিলিতেছে না। সঙ্কোচের বিহ্বলতায় নিজের অপমান আপাদমস্তক নিজেকে নতজানু পর্যায়ে লইয়া যাইতেছেÑ অন্যায় অনিয়ম আর অবাধ্যতারা বসিবার, কথা বলিয়া বনমালীর ঘরে যে শুইবার এন্তেজাম করিতেছে এই দিকে বনমালীর মন নাই।
দূর প্রাচ্যে, সাত সাগর আর তের নদীর পাড়ে, ফুলে ফুলে শোভিত এক স্বপ্নরাজ্যে এ দেশের এক দুধকুমার একবার হঠাৎ করিয়া বিস্তর নগদ এনাম লাভ করিয়া বসিলেন। সেই দেশের এমনই নিয়ম যে, যেখানে তিনি ইহা লইয়া যাইবেন সেখানেই প্রশ্ন পাইবেন ‘ইহা ভাই আপনি কোথায় পাইলেন?’ এই প্রশ্নে দুধকুমারের লা জবাব অবস্থা দেখিয়া অনেকেই মজা পাইলেন। এর কোনো জবাব তাহার মগজে নাই। অগত্যা তিনি একটি সিন্দুক কিনিলেনÑ এই সিন্দুক তাহার ঘরে উঠাইবার সুযোগও সীমিত। কেননা, সে দেশে বাসগৃহে কেহ বড় সিন্দুক ব্যবহার করে নাÑ হাজার বছর আগে ইহার চল উঠিয়া গিয়াছে। কেননা ছেঁচড়া চোর, হাত সাফাই এই জাতীয় বদ খাসলতদিগকে নির্বাসনে পাঠানো হইয়াছে। সবই আমানতদারের জিম্মায় রাখিবার বিধান চালু রহিয়াছে। অগত্যা দুধকুমার বিদেশী বাড়ির জানালা কাটিয়া তাহার ঘরে সিন্দুক প্রবেশাইলেন এবং যথারীতি তথায় যাবতীয় নগদের নিবাস নির্ধারণ করিলেন। দুধকুমারের ভাগ্য ভালো, সেই দেশে দস্যুতায় দুর্দান্ত সম্রাটের পুত্ররা নাই। নইলে ইহা তাহাদের জিম্মায় চলিয়া যাইতে বিলম্ব হইত না। সেই দেশে এমনই নিয়ম যে, একটি আস্ত গাড়ি মাগনা দিলেও কেউ লইতে চায় না, কেননা সেই গাড়ির লাইসেন্স, রুট পারমিট, ইন্স্যুরেন্সের দাবি মিটাইতে এবং ইহার মালিকানা লাভের হলফনামা রচনায় চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারের অবকাশ ঘটিয়া যাইবে। সেই দেশে পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাইয়াছে। সুশাসনের মন্ত্র পড়াইয়া পদ্ধতি প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে নাই।
বঙ্কিমবাবু আগের শতাব্দীর লোক ছিলেন। ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। কপালকুণ্ডলার আঁকিয়ে ছিলেন। ‘তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ Ñএই প্রশ্ন নিজের কাছে সে সময় সতত রাখিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। কখনো ভাবেন নাই, তাহার ভাবীকালের ভাতিজারা ‘তুমি অধম তাই আমিও অধমের মতো আচরণে অধিকারপ্রাপ্ত হইয়াছি’ বলিয়া বিবৃতি দিতেও বিব্রত বোধ করে না। বরং এই রূপ বিবৃতি দিয়া যেন ‘হাইব্রিড নেতা হিসেবে বাহবা লভিবে তুমি এই সোনার ভুবনে’। বঙ্কিমবাবু হয়তো ভাবেন নাই, তাহার প্রপৌত্ররা ‘মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করিয়াছে গমনের’ প্যারোডি সাজাইয়া ‘যাহারা গিয়াছে গোল্লায়’ আমরা তাহাদের টেক্কা দিয়া ‘দেখাইমু ওরে আঁরাও কম না’। ভাবখানা এইÑ খোকা বোতল ভাঙ্গিয়াছে সুতরাং বোতল ভাঙ্গার গানকে জাতীয়করণ করোÑ খোকা অধিকতর উদ্যমে বোতল ভাঙ্গিতে উদ্বুদ্ধ হইবে।
প্রায় শতবর্ষ পূর্বে রবি বাবু নামে মশহুর এক কবি ভাবিয়াছিলেন ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তাহারা উভয়ে সমান যাতনা সহ্য করিবে।’ তাহার শতবর্ষ পরে বাবু মহাশয় বাঁচিয়া থাকিলে ঠিকই দেখিতে পাইতেন, এখন দোষীকে দিগম্ব^র করা নহে বরং আঁচলের তলায় রাখিয়া খাঁটি গরুর দুধ ও দেশী কলা খাওয়ানো হইতেছে। চৌর্যবৃত্তিতে পটুরা মাসতুতো বা খালাতো ভাই কিংবা ফাস্ট কাজিনের মতো আত্মীয়তা পাতাইয়া ‘মুই-এর বাড়ি বরিশাল তোমার বাড়ি ঘোড়াশাল; আমাদের মধ্যে কত মিল’ জাতীয় হেঁয়ালি সঙ্গীত লাফাইয়া দাপাইয়া ঘাঁটাইয়া মাঠাইয়া চলিতেছে। শুধু ভালোবাসাবিহীন ‘সত্য’ জানালা দিয়া নহে, ‘ভদ্রতা’ও বিনা টিকিটে পাসপোর্ট-ভিসা, করোনার টিকা সনদ ছাড়াই নদী সাগর পাড়ি দিয়া চলিয়া যাইতেছে অমুক তমুকের দেশে। মাথায় বিস্তর টাক লইয়া চুল সংরক্ষণের ফতোয়া দিয়া যাইতেছেন বাঁশের চাহিয়াও’ প্রলম্বিত ‘প্রতি’ভাবানরা। ‘উপ’দের উপদেশে আসলদের ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা। বর্ণচোরাদের বন্যায় ত্যাগী ও নিবেদিতরা হালে পানি পাইতেছে না। পানি ও তৈল, দুধ ও ঘি এক দেহে লীন হইয়া একে অপরকে টেক্কা মারিয়া বহাল তবিয়তে থাকিতেছে। থাকিবার উপায়ের উপলক্ষের অভাব নাই, কাজীর খাতাতেও হিসাব অফিসের খাতায় হিসাব রাখিবার বালাই নাই; একের মাসোহারা অন্যরা লইয়া যাইতেছে এবং দফতরবিহীনদের মিছিল লম্বা হইতেছে। মুহূর্তের মধ্যে অজানা বস্তায় কাঁঠাল গজাইতেছে। বায়োস্কোপের মতো একটির পর একটি ঘটনা ও রটনা আসিয়া চাল ডাল হইতেছে, গাছ মাছ হইতেছে, নদী খাল হইতেছে, ভবন সদন হইতেছে।
চৌরাস্তায় গোলাপ মিয়া দাঁড়াইয়া দাঁত মাজিতেছিল, হঠাৎ সাদা সরদার আসিয়া বলিল, ‘আমাদের বৈঠকখানায় আসিও; পিঁড়া দিবো বসিতে’। ও পাড়ার মানু মুনশির মেয়ে নীল নীলাঞ্জনা আসিয়া বলিল, ‘দাদা, আমাদের দহলিজে আসিয়া চিড়ামুড়ি খাইবেন’। নিরপেক্ষ বেচারা গোলাপ মিয়া। কাহারো ডাকে তাহার সাড়া দিবার ইচ্ছা নাই; কিন্তু ইচ্ছা তাহাকে করিতে হইবে নইলে তাহাকে উভয় পরে বাদি-বিবাদির মালা পরাইয়া সন্ন্যাসী সাজানো হইবে, বানানো হইবে ‘অজ্ঞাত সংখ্যক’দের একজন। গোলাপ মিয়াদের সুদিন সুখ্যাতি এখন সাদা-কালোর সুতায় প্যাঁচাইয়া, আকাশের যত তারা তত ধারায় লটকাইয়া কাশিমবাজার কুঠি হইতে কাশিমপুরে পাঠাইবার প্রজ্ঞাপন হইতেছে হরহামেশা। কালো সাদাকে পেটে পুরিয়া, গোলাপকে আত্মসাৎ করিয়া বেমালুম সগৌরবে সকলের সামনে দিয়া চলাচল করিতেছে। গুণকীর্তনে বাঁধা সাধা হইতেছে বলিয়া রাধারা আর কাহাকে নাচিতেও দিতেছে না। কেহ অন্ন চাহিলে কলা চুরির কেচ্ছা শুনাইয়া, সঙ্গীত সন্ধ্যা সকালের আমন্ত্রণে চালানো হইতেছে। ইহা যেন বিকালে ভোরের ফুলÑ সাদা-কালোর মালতী মাধুরীর পথে যাত্রা। শোক সামলাইয়া সত্য যথা তথায় সমাহিত হইতেছে।
লেখক : কলামিস্ট, সাবেক সচিব


আরো সংবাদ



premium cement
আইনজীবী হত্যায় উত্তাল চট্টগ্রাম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে : ড. ইউনূস বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিভক্ত না হতে মাহাথিরের আহ্বান ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর তিন মাস পার হলেই সব ঋণ খেলাপি মিয়ানমারের জেনারেল মিন অংয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা চাইলেন আইসিসির প্রসিকিউটর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালাস পেলেন খালেদা জিয়া কিছু মানুষ জাতিকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন : ফখরুল আইনজীবীর হত্যাকারী ‘বঙ্গবন্ধু সৈনিক’ শুভ কান্তি দাস কে? এশিয়া ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড পেল অধিকার চিন্ময় ইস্যুতে ভারতের বিবৃতি দেয়া অনধিকার চর্চা : উপদেষ্টা নাহিদ

সকল