২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ভয়াল ২৫ মার্চের কালরাত

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা

-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বর্ণাঢ্য। একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে এ দেশের মুক্তি অর্জিত হয়েছিল। এর চূড়ান্ত পর্বের যাত্রাটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। এক ভয়াল কালরাতের দুঃসহ স্মৃতিবিজড়িত এ দিন। সে দিন রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালিয়েছিল হানাদার বাহিনী। বাঙালির স্বাধিকার চেতনা মুছে ফেলার লক্ষ্য নিয়ে সেই রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। লেলিয়ে দিয়েছিল সশস্ত্রবাহিনীকে নির্বিচার বাঙালি নিধনে। তাদের সেই বর্বর সামরিক অভিযান সফল হয়নি। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা যুদ্ধ করে পেশাদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করে বরং স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছে।
১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে আলোচনা করছিলেন। আলোচনা চলার মধ্যে কোনো ঘোষণা ছাড়া শাসকগোষ্ঠী রাতের আঁধারে বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদরত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। এই আক্রমণ ছিল বাঙালির রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সামরিক ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের মিলিত চক্রান্তে সাধারণ মানুষের ওপর শুরু হয় মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা।
’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী এই দলটিরই তখন সরকার গঠন করার কথা। শেখ মুজিব হওয়ার কথা সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আলোচনা সেভাবেই এগোচ্ছিল বলে জাতি আশা করছিল। স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ করে দেয় পাকিস্তানের প্রভুত্ববাদী সামরিক ও রাজনৈতিক অভিজাত গোষ্ঠী। পরবর্তী আলোচনার মুলো ঝুলিয়ে রেখে ইয়াহিয়া-ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা রাতের অন্ধকারে ঢাকা ছেড়ে যান। ক্ষমতাবান এ চক্র কতটা অনৈতিক তাদের কার্যক্রম থেকে এটা প্রমাণ হয়। তারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবারুদ নিয়ে অভিযান চালাবে, তা প্রকাশ করেনি। পরবর্তী সময়ে অনুমান হয়, তারা অস্ত্রের ভাষায় বাঙালির অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। একটি জাতিকেই তারা স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল কার্যত, যা সম্ভব হয়নি।
এক দিকে রাতের আঁধারে সামরিক রাজনৈতিক নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। অন্য দিকে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও তাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র এ দেশে পাঠানো হয়। ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে নিরস্ত্র মানুষের ওপর তারা হামলে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দেয় এ সামরিক অভিযানের। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে হত্যা করা। নির্মম এই হত্যাযজ্ঞই কার্যত বাঙালিকে বাধ্য করেছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করতে। নির্মমতার সমুচিত জবাব দিয়ে আমরা ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছি স্বাধীন-সার্বভৌম নতুন স্বদেশ, বাংলাদেশ।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের এই কালো দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার। দিনটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিকভাবেও দিনটি পালনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসঙ্ঘে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। বর্তমান সরকার সাধারণত কোনো দিবস ঘোষণা ও উদযাপনের জন্য খুবই আগ্রহী; কিন্তু এর প্রকৃত চেতনা রক্ষায় তার উল্টো, ততটাই উদাসীন। তারা এ দিবসের চেতনা বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কিছু করেনি বলে অভিযোগ। তবে বরাবরের মতো জাতীয় পর্যায়ে দিবসটি ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হয়ে আসছে।
পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা ও তার বিপরীতে বাঙালির ইস্পাত কঠিন ঐক্য একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, সেই আত্মত্যাগের অর্জন আমরা কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর দেখা যাচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে আমরা এখন সেই পুরনো বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়ে গেছি। কিংবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়। যে স্বাধীনতার জন্য অকাতরে আমাদের রক্তদান সেই স্বাধীনতা এখনো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা এখনো একটি ইনসাফপূর্ণ মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি। গড়ে ওঠেনি বৈষম্যহীন নাগরিকতা। এখন আমাদের গণতন্ত্রের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। আমাদের মতপ্রকাশের অধিকার অতিমাত্রায় সীমিত। আমাদের মানবাধিকার দুর্বল। ২৫ মার্চের আত্মবলিদানকে সার্থক করতে হলে সব সেক্টরে উন্নতি দরকার। আজ আমাদের শপথ নিতে হবে একটি প্রকৃত স্বাধীন শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে। না হলে আমাদের সেই রক্তদান অনন্তকাল ধরে বৃথাই থেকে যাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement