২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
সড়কে প্রাণহানি আরো বেড়েছে

প্রতিশ্রুত দাবি পূরণ করেনি সরকার

-

আমাদের সড়ক-মহাসড়ক যেন মানুষের প্রাণ হরণের একটা ফাঁদ হয়ে আছে। আর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েই চলেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত সারা বছরের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান থেকে এমনই জানা যাচ্ছে। দুটো প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দুর্ঘটনা ও তাতে মানুষের হতাহতের সংখ্যা উভয়টিই খুব বেশি। আগের বছরগুলোর চেয়ে তা বেশি হারে বাড়ছে। অথচ সড়কে বেঘোরে মানুষের প্রাণহানি নিয়ে বড় আন্দোলন হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদের ২০১৮ সালের আন্দোলন এক নজিরবিহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। সরকার তাদের দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে সড়কে চলা বেআইনি জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে সরকার যদি অঙ্গীকার রক্ষা করত তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার লাগামহীন যন্ত্রণা জনগণকে ভোগ করতে হতো না। দেখা যাচ্ছে, সড়কে প্রাণহানির জন্য যানবাহন নিয়ন্ত্রণকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে সরকার উদ্যোগী হয়নি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ছয় হাজার ২৮৪ জন। আহত হয়েছেন সাত হাজার ৪৬৮ জন। অন্য দিকে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘ দিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতিষ্ঠান নিরাপদ সড়ক চাই-এর (নিসচা) হিসাবে গত বছর সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৭৯৩টি। এতে প্রাণ হারিয়েছেন চার হাজার ২৮৯ জন, আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৪২৪ জন। পরিসংখ্যানে ফারাক থাকলেও এটা সবারই জানা যে, সারা দেশে উচ্চহারে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক দুর্ঘটনাই বেখবর হিসেবে থেকে যায়। কারণ সব দুর্ঘটনা সংবাদমাধ্যমে খবর হয় না। প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত সংবাদমাধ্যম থেকে সড়ক দুর্ঘটনার খবর সংগ্রহ করে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সংবাদমাধ্যমের কাছে মন্তব্য করেন, সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা চার বা পাঁচ গুণ বেশি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, ২০২০ সালের তুলনায় পরের বছর সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩ শতাংশ আর প্রাণহানি বেড়েছে ১৭ শতাংশ। ২০২০ সালেও সড়ক দুর্ঘটনার হার ছিল বেশি। ওই বছর করোনার লকডাউনে দীর্ঘ দিন সড়কে যোগাযোগ সীমিত থাকার পরও এমনটি হয়েছে। এসবের মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। গত বছর দুর্ঘটনার ৬২ শতাংশের কারণ এটি। অন্য কারণগুলোর মধ্যে ছিল চালকদের অদক্ষতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও বিআরটিএ’র সক্ষমতার অভাব। অথচ ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সরকার এসব ঠিকঠাক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, গত বছর ৮০৩ জন শিক্ষার্থী সড়কে প্রাণ দিয়েছে। সড়কে প্রাণহানির ১৩ শতাংশই ছাত্র।
প্রাণহানির পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনায় বিপুল সম্পদের ক্ষতিও হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর এর আর্থিক মূল্য ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির দশমিক ৩ শতাংশ। এতে যানবাহন ও সম্পদের ক্ষতির হিসাবে পূর্ণ সঙ্কলন করা যায়নি। দুর্ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিকটি উপেক্ষিত থেকে যায়। দুর্ঘটনার সূত্র ধরে পরে অনেকে প্রাণ হারান। তাদের হিসাবটি আর কোথাও পাওয়া যায় না। দেখা যায়, অনেকে পঙ্গু-খোঁড়া হয়ে যান চিরতরে। তাদের যে অপূরণীয় ক্ষতি সেটিও থেকে যায় আড়ালে। এসব ব্যক্তির পরিবার সারা জীবন এর পরিণাম ভোগ করে। কেউ নেয় না এ ভুক্তভোগীদের দায়িত্ব।
বাংলাদেশের সড়ক ও পরিবহন একটি চক্রের খপ্পরে পড়ে আছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এদের রয়েছে দাপট। তাই এই খাতে সংস্কার করা হয় না। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে সরকার চানক্যনীতি অবলম্বন করে। শুধু আন্দোলন সামাল দেয়ার জন্য সাময়িক দাবিদাওয়া মেনে নেয়; কিন্তু প্রভাবশালীদের চক্র থেকে সড়ক পরিবহন-ব্যবস্থাকে উদ্ধারে শক্ত পদক্ষেপ নেয় না। তাই বছর বছর মানুষকে উচ্চহারে সড়কে প্রাণ দিতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করা আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব নয় বলেই মনে হচ্ছে। তবে মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এ খাতকে গ্রাসকারী দুর্বৃত্ত চক্রকে হটাতে পারে। আমরা আশা রাখব, একসময় এ দুর্বৃত্তরা পিছু হটবে। আর আমাদের সড়কে পূর্ণ শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।


আরো সংবাদ



premium cement