২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন

সরকারের আন্তরিকতা দেখার অপেক্ষা

-

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বহু কথা হয়েছে, অনেক তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। অসংখ্য মানুষ হয়রানি, জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ আইনে কারাগারে আটক ব্যক্তির মৃত্যুও ঘটেছে। অথচ আইন প্রণয়নের সময় এর সব বিরোধিতা ও আপত্তি গলার জোরে উড়িয়ে দিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বলেছিলেন, এই আইনের অপব্যবহার হবে না। তারা চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন এই আইনের মানবাধিকার ও সংবিধান পরিপন্থী বিভিন্ন ধারার ব্যাপারে। এমনকি সারা দেশে যখন সরকারি দলের লোকজন সামাজিক মাধ্যমে সামান্য সমালোচনার জন্য সাধারণ নাগরিকদের টুঁটি চেপে ধরছিলেন মামলায় জড়িয়ে, গ্রেফতার করে এমনকি শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে। তখনো মন্ত্রীরা জোর গলায় এই আইনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন নির্দ্বিধায়।
অবশেষে সম্প্রতি আইনমন্ত্রীই এখন স্বীকার করলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু অপব্যবহার ও দুর্ব্যবহার হয়েছে। আইনটি যে, সারা দেশে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ সাধারণ নাগরিকদেরও সত্য কথা বলার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে; সেটি এখনো স্বীকার করা হয়নি। আইনমন্ত্রী এই আইনের নিবর্তনমূলক ধারাগুলো সংশোধন করার উদ্যোগের কথাও বলেছেন। মন্ত্রীর এই স্বীকারোক্তির পেছনের কারণ যা-ই হোক না কেন, এটি সত্যিই আশার কথা। তবে এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের অংশ এবং দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সত্যিই সরকার আন্তরিকভাবে কাজটি করছে কি না। নাকি সংশোধনের নামে কোনো নতুন ফাঁকফোকর বের করার চেষ্টা করছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক এ আইনের সংশোধনের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের কার্যকর বাস্তবায়ন দেখার অভিপ্রায়ে নিবর্তনমূলক আইনটি মানবাধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক কি না তা পর্যালোচনা ও সংশোধনে যে কমিটি গঠন করা হবে তাতে গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধি রাখার কথা বলেছেন। সেই সাথে টিআইবি শুধু গণমাধ্যমকর্মী নন, যেকোনা নাগরিকের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা-মোকদ্দমা করা হলে অভিযুক্তকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার না করার দাবিও জানিয়েছে। কিন্তু সরকার যদি সত্যিই আইনটি সংশোধনে আন্তরিক হয়; তাহলে কেবল তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার নয় বরং এ আইনে মামলা দায়েরও স্থগিত করা উচিত। কারণ আইনটির মাধ্যমে এরই মধ্যে অনেকে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এক তথ্যে দেখা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিশেষ ধারায় শুধু ২০২১ সালের ১১ মাসেই মামলা হয়েছে ২২৫টি, যেখানে চার শতাধিক মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৬ জনকেই আটক বা গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার এসব মামলার বড় অংশই হয়েছে নিছক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের নেতা অথবা প্রভাবশালীদের কটূক্তি ও সমালোচনার জন্য। অর্থাৎ আইনটি শুধু যে গণমাধ্যমেরই কণ্ঠরোধ করেছে তা নয়, বরং সুস্পষ্টভাবে সাধারণ নাগরিকেরও ভিন্নমত এবং সরকারের ন্যায়সঙ্গত সমালোচনার পথ রুদ্ধ করতে ব্যবহার করা হয়েছে। এ আইনে করা মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদ মারা গেছেন। এই মৃত্যুসহ ২০১৮ সালের অক্টোবরে আইনটি জারির পর থেকে যত অত্যাচার-নির্যাতন-জেল-জুলুমের ঘটনা ঘটেছে তার কোনোটারই দায় সরকার এড়াতে পারে না।
বিধান প্রণয়নে বিশ্বের সেরা চর্চাগুলোর অনুসরণ করে আইনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে বলে উল্লেখ করেছেন আইনমন্ত্রী। আমরা বলি, বিশ্বের সেরা চর্চা অনুসরণের প্রয়োজন নেই। বরং এই আইনের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং মানবাধিকারপরিপন্থী ধারাগুলো সম্পূর্ণ বিলোপ করে সর্বজনীন মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এমন আইন করা হোক যা সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement