২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
যাত্রী নিরাপত্তা ভঙ্গুর অবস্থায়

কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর উদাসীনতা

-

দেশে একের পর এক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটছে। কিছু দুর্ঘটনায় বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার পর এর কারণ জানা যাচ্ছে। দুর্ঘটনার ওই সব কারণ যে প্রতিরোধযোগ্য ছিল সেটিও বোঝা যাচ্ছে। তারপরও কেন একই দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি। একটি কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, আসলে দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। যারা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অনিয়মগুলো রোধে ব্যবস্থা নেবেন তারা উদাসীন। সাম্প্রতিককালে আমরা রেল ক্রসিংয়ে উপর্যুপরি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি দেখেছি। অন্য দিকে সড়কে প্রাণহানি নিত্যদিনের ঘটনা। সেখানেও মূল কারণ কর্তৃপক্ষীয় দায়িত্বহীনতা। কিন্তু যারা অবহেলা করছেন তাদের বিচার কিংবা শাস্তি পেতে হয় না।
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি যাত্রার অনুমতি দেন বিআইডব্লিউটিএ’র স্থানীয় দায়িত্বশীল পরিবহন পরিদর্শক। তিনি লঞ্চটির যাত্রীর সংখ্যা ২১৭ বলে ঘোষণা দেন এবং লঞ্চটিতে কোনো ত্রুটি নেই বলে উল্লেøখ করেন। অথচ বেঁচে যাওয়া মানুষের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, লঞ্চটিতে আট শতাধিক যাত্রী ছিল। অন্য দিকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি লঞ্চটিতে ত্রুটি পেয়েছে। জানা যাচ্ছে, পরিদর্শকরা খুব কমই লঞ্চ পরিদর্শন করে যাত্রার অনুমতি দেন। এমনকি যাত্রা শুরুর জন্য যাত্রীর সংখ্যা, লঞ্চে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বিবেচনার বদলে তারা ‘কিছু টাকা’ নেন। অর্থাৎ কিছু টাকা পেলে সব ‘ঠিক আছে’ মৌখিক সনদ দিয়ে নৌযানকে যাত্রার অনুমতি দিচ্ছেন। অথচ দুর্ঘটনার পর পরিদর্শন করে দেখা যায়, লঞ্চটিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল না। দুর্যোগ কিংবা ডুবে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়লে বাঁচার জন্য বালুর বাক্স ও বয়া ছিল না। ইঞ্জিন-কক্ষ সংলগ্ন ডিজেলবোঝাই বেশ কয়েকটি ড্রাম রাখা ছিল। ওই কক্ষের পাশে রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। এগুলো সবই বিপজ্জনক দাহ্যপদার্থ। লোকজন যারা লঞ্চটিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন তাদের বৈধ অনুমতিও ছিল না। প্রশ্ন হলো-একজন পরিদর্শকের কাজ কী? তিনি যদি যাত্রার আগে লঞ্চটি সত্যিকার অর্থে পরিদর্শন করতেন; তাহলে এতসব বিচ্যুতি দেখতে পেতেন। অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে লঞ্চটির যাত্রা স্থগিত করে দিতে পারতেন। এতে করে অগ্নিদুর্ঘটনা হয়ত এড়ানো যেতে পারত।
লঞ্চটির যেসব অনিয়ম-ত্রুটি এখন পাওয়া গেছে, এর জন্য কি একাকী এর মালিক ও কর্মচারী এমনকি ওই পরিদর্শক দায়ী? প্রতিদিন দক্ষিণাঞ্চলে এ ধরনের শত শত নৌযান চলে। যেগুলোতে হাজারো যাত্রী চলাচল করেন। নৌযানগুলোতে এখন যদি অভিযান চালানো হয়, দেখা যাবে বেশির ভাগের কোনো না কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যাবে। সরকারি কর্তৃপক্ষ নিজেদের তৈরি করা আইন-কানুন ঠিকভাবে মানলে একটি নৌযানও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হওয়া ছাড়া নৌপথে যাত্রী পরিবহন করতে পারত না। আগের দুর্ঘটনার পর এটাই স্বাভাবিক ছিল, প্রত্যেকটি নৌযানকে নিরাপদ করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালান। পরিদর্শকের যে গাফিলতির কথা উঠে এসেছে সেটি প্রত্যেক নৌযানের ক্ষেত্রে ঘটছে; কিন্তু শুধু দেখার ভান করা হয়েছে। এতে বোঝা যায়, আগের দুর্ঘটনাগুলোর পর সরকারের দায়িত্বশীল পক্ষ যেসব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি করেছিল সেগুলোর কিছুই পূর্ণ করা হয়নি। গাফিলতির একটি সীমা থাকে; কিন্তু দেশে এর সীমা-পরিসীমা নেই।
এখন মামলা করা হয়েছে মালিক ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধ। এর আগেও এ ধরনের আংশিক বিচারের আয়োজনই হয়েছে। অথচ এই অপরাধ তো সঙ্ঘবদ্ধভাবে করা হচ্ছে। নৌপরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে পরিদর্শকও এর জন্য দায়ী। সুতরাং তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে একসময় সব কিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। হয়তো ফের বহু মানুষের মৃত্যুর পর আবার কিছুটা হইচই হবে। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে একই ধরনের উদাসীনতা ও গাফিলতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এর সাথে সরকার, মালিক ও শ্রমিক রাজনীতিও জড়িত। সব মিলিয়ে রয়েছে একটা দুষ্টচক্র। এ চক্র ভাঙতে হবে। এর জন্য দরকার বড় ধরনের সংস্কার। চক্রের নিচের দুর্বল অংশের কিছু মানুষকে শাস্তি দিয়ে উপরের অংশকে বহাল রেখে দেশে যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না।


আরো সংবাদ



premium cement