১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪ মাঘ ১৪৩১, ১৭ রজব ১৪৪৬
`
জনআকাক্সক্ষা পূরণের সুপারিশ

সংস্কার বাস্তবায়নে শৈথিল্য নয়

-

একাত্তরে একটি সশস্ত্র জনযুদ্ধে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, সেই রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল বৈষম্যহীন। কারণ, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সেই অঙ্গীকার করা হয়েছিল। ওই ঘোষণাপত্রে সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার- এ তিন জনপ্রত্যাশা নিয়ে এই জনপদের মানুষ মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জীবন দিয়েছিল এতে লাখো মানুষ। দেশ স্বাধীনের পরে সবার আশা ছিল, নতুন এই রাষ্ট্রে সব মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পাবেন তাদের পূর্ণ মানবিক মর্যাদা। কিন্তু দীর্ঘ ৫৪ বছরে স্বাধীনতা সংগ্রামের জনআকাক্সক্ষা পূরণ হওয়া তো দূরের কথা, এর ধারেকাছেও পৌঁছা সম্ভব হয়নি।
বাস্তবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়িত না হয়ে কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ। আরো দেখা গেছে, গণতন্ত্র নির্বাসন দিয়ে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রবর্তন করা হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা। অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময়েও এ দেশে গরিব আরো গরিব হয়েছে। শাসক ও ধনিক-বণিক শ্রেণী মিলেমিশে গড়ে তুলেছে একটি দুর্বৃত্তায়নের দুষ্টচক্র। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই চক্র জনগণের সম্পদ অবাধে লুণ্ঠন করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। ফলে সমাজের প্রতিটি স্তরে বৈষম্য মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। বৈষম্যের জাঁতাকলে স্পৃৃষ্ট সাধারণ মানুষ স্বদেশেও নিজেদের অসহায় বোধ করেন। বিশেষ করে গত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদী শাসনে দেশের মানুষ হারান তাদের সব নাগরিক ও মানবিক অধিকার।
এই যে ব্যর্থতা, এর জন্য প্রধানত দায়ী এ দেশের রাজনীতিকরা। তাদের স্বার্থপরতায় দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো অঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রের সব অঙ্গে বাসা বাঁধে দুর্নীতি ও নীতিহীনতা। ক্ষমতাসীনদের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় গিয়ে সম্পদশালী হওয়া। ফলে স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা বাংলাদেশকে বর্তমান সময়ের উপযোগী একটি কার্যকর মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি।
এমন প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষ ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন ঘটান। হাসিনা-উত্তর দেশে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ, দেশের সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। দায়িত্ব নেয়ার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন। সেগুলোর মধ্যে চারটির সদস্যরা গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের সুপারিশমালা হস্তান্তর করেছেন।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানোসহ সংবিধানে আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আরো সুপারিশ করা হয়েছে- সংবিধানের মূলনীতি ও সংসদের কাঠামোতে পরিবর্তন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো, মৌলিক অধিকারের পরিসর বাড়ানো, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলসহ সংবিধানের নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। একইভাবে দুদক সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন নিজ নিজ সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বাকি সব সংস্কার কমিশন নিজ নিজ সুপারিশমালা দ্রুত দাখিল করতে সক্ষম হবে। কমিশনের সুপারিশের আলোকে রাষ্ট্রসংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে বসবে।
দেশবাসী আর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মতো এই সুপারিশমালা কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ দেখতে চায় না। অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে জনপ্রত্যাশার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement