১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বাজারে যে ধরনের প্রভাব ফেলছে

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বাজারে যে ধরনের প্রভাব ফেলছে - সংগৃহীত

দেশে সরকারিভাবে ডলারের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যেই পণ্যের দামের উপর সেটির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই বেড়ে গেছে চাল, ডাল, আটা এবং ভোজ্য তেলের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্যের আমদানি ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে জিনিসপত্রের বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

‘ডলারের দাম এক লাফে সাত টাকা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের খরচও অনেক বেড়ে গেছে। কাজেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো ছাড়া তো উপায় নেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিকারক মোহাম্মদ মাজেদ।

যদিও এত অল্প সময়ে মধ্যে খাদ্যপণ্যের দামে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

‘বেসরকারিভাবে আমদানির ক্ষেত্রে তারা (ব্যবসায়ীরা) তো এতদিন ১১৭ টাকার বেশি দামে ডলার কিনেই পণ্য আমদানি করেছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

‘কাজেই ডলারের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ানো অযৌক্তিক,’ বলেন হোসেন।

যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে
বাংলাদেশে খাদ্যশস্য ও মসলার বাৎসরিক চাহিদার একটি বড় অংশ আমদানি করা হয়।

সেগুলোর মধ্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, ছোলা, সয়াবিনসহ বিভিন্ন রকম নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য রয়েছে।

ডলারের দাম বাড়ার ঘোষণার পর থেকেই সেসব খাদ্য পণ্যের বাজারে বেশ অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে।

সোমবার ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকে প্রকাশিত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তালিকায় দেখা যাচ্ছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে মোটা চাল এক শতাংশ এবং সরু চালের দাম প্রায় তিন শতাংশ বেড়েছে।

একই সময়ে, প্যাকেটজাত আটার দাম কেজিতে সাড়ে চার শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেল এবং সুপার পাম ওয়েলের দাম সাড়ে ৯১ শতাংশ, নেপালি ডাল প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ এবং এলাচের দাম প্রতি কেজিতে প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়ে গেছে।

দু’টি কারণে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

‘এলসি খোলার জন্য আগে যেখানে ১০ শতাংশ টাকা জমা দিলেই চলতো, এখন সেখানে শতভাগ টাকা জমা দিয়ে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকার শ্যামবাজারের খাদ্যপণ্য আমদানিকারক প্রদেশ পোদ্দার।

এতে ব্যবসায়ীদের অনেকেই পণ্য আমদানি কমিয়ে দেয়ায় বাজারে পণ্যের সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। আর তাতেই দাম কিছুটা বেড়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন পোদ্দার।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আবার ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা।

‘আগে যেসব পণ্য আমরা ১১০ টাকা রেটে বাকিতে আমদানি করেছি, ডলারের দাম বাড়ানোর ফলে সেগুলো এখন ১১৭ টাকা রেটে পরিশোধ করতে হচ্ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন আমদানিকারক মোহাম্মদ মাজেদ।

এ ঘটনায় গত এক সপ্তাহে কয়েক কোটি টাকা বেশি খরচ হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

‘এই টাকা তো আমি পকেট থেকে দেবো না। কাজেই দাম বাড়ানোটাই স্বাভাবিক,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মাজেদ।

একই সাথে, আমদানি শুল্ক, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়াতেও খাদ্য ও কৃষিপণ্যের দাম বাড়ছে বলে জানান তিনি।

জ্বালানি তেল
বিশ্ববাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইতোমধ্যেই জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ করা শুরু করেছে সরকার। ডলারের দামের উপর নির্ভর করে প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের নতুন মূল্য ঘোষণা করা হচ্ছে।

চলতি মে মাসের জন্য ঘোষিত দামে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনে বেড়েছে এক টাকা। এছাড়া পেট্রোল ও অকটেনের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি আড়াই টাকা।

কিন্তু এই মূল্য যখন নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন দেশে ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা।

এখন ডলারপ্রতি দাম সাত টাকা বেড়ে যাওয়ায় আগামী মাস থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দামও বেড়ে যেতে পারে বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

‘আমাদের জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। কাজেই সব ধরনের জ্বালানি তেলের দামের উপরে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি নিশ্চিতভাবেই একটা প্রভাব রাখবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

আর জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহনসহ এর উপর নির্ভরশীল অন্যান্য অনেকখাতেই খরচ বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন মি. হোসেন।

রাসায়নিক সার
জ্বালানি তেলের মতো আমদানি করা রাসায়নিক সারের দামও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত রাসায়নিক সারের উল্লেখযোগ্য একটি অংশই আনা হয় বিদেশ থেকে।

আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, মরক্কো, তিউনিশিয়া, চীন, জর্ডান, বেলারুশ, রাশিয়া এবং কানাডা থেকে প্রতিবছরই লাখ লাখ টন ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, ডিএপিসহ বিভিন্ন ধরনের সার আমদানি করা হয়।

‘ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে সেগুলোর আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। এর ফলে কৃষি ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন অর্থনীতিবিদ হোসেন।

বিদ্যুৎখাতে যে প্রভাব
বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মূলত গ্যাস, কয়লা এবং জ্বালানি তেলের উপর নির্ভরশীল। আর এগুলোর বড় অংশই আমদানিনির্ভর।

বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে।

কিন্তু সেগুলোর দামও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এমন অবস্থার মধ্যে দেশে ডলারের দাম বৃদ্ধি সার্বিকভাবে বিদ্যুৎখাতের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

‘আর বিদ্যুতের জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে সরকারের যদি খরচ বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রে সেটি জনগণের উপরেও বর্তাতে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তামিম।

বাড়বে গাড়ির দাম
আমদানিনির্ভর হওয়ায় ডলারের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে সব ধরনের গাড়ির দামও বেড়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

‘ডলাররের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন থেকে সব ধরনের গাড়ির আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন গাড়ি আমদানিকারক আব্দুল হক।

এছাড়া বিলাসদ্রব্য হওয়ায় আমদানি শুল্কও বেশি পড়বে।

‘সব মিলিয়ে গাড়ি কিনতে হলে ক্রেতাদেরকে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন হক।

তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় গাড়ির ব্যবসায় মন্দা দেখা দিতে পারে বলেও শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

‘এখনই বাজারের অবস্থা খুব একটা ভালো না। এরপর দাম আরও বাড়লে শো-রুম বন্ধ করে দেয়া লাগতে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন গাড়ি আমদানিকারক আব্দুল হক।

এগুলোর বাইরে, বিদেশী এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম, লোহা, ইস্পাত আরো বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী এবং অর্থনীতিবিদরা।

কারণ এসব পণ্য ও সেবাগুলো নেয়া বা আমদানি করা হয় ডলারের বিনিময়ে।

ডলারের দাম বাড়লো কেন?
বাংলাদেশ প্রায় দুবছরেরও বেশি সময় ধরে ডলার সঙ্কট চলছে।

এর মধ্যে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়। যদিও খোলা বাজারে লেনদেন হচ্ছিলো আরো বেশি দামে।

এমন অবস্থায় ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে গত ৮ মে ব্যাংকগুলোকে ১১৭ টাকায় মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয় করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এছাড়া গত বছরের শেষ দিক থেকেই আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে এ পদ্ধতি চালু করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল।

‘ক্রলিং পেগ’ হচ্ছে দেশীয় মুদ্রার সাথে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়।

এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে এটি একবারেই খুব বেশি বাড়তে বা কমতেও পারবে না।

তবে নতুন এ পদ্ধতিতে ‘ক্রলিং পেগ মিড রেট’ বা ‘সিপিএমআর’ ১১৭ টাকায় নির্ধারণ করার কারণে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছে এবং আন্তঃব্যাংক চুক্তির ক্ষেত্রে সিপিএমআরের কাছাকাছি দামে মার্কিন ডলার ক্রয় বা বিক্রয় করতে পারবে।

এই ১১৭ টাকা মূলত ডলারের বিপরীতে টাকার একটি মধ্যবর্তী হার। ব্যাংকগুলো এর চেয়ে কম-বেশি দাম নিতে পারবে তবে সেটি খুব বেশি পার্থক্য করা যাবে না।

ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন ডলার কেনাবেচার দামের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে।

আইএমএফের সাথে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি রয়েছে, যার দুই কিস্তির টাকা দেশটি পেয়েও গেছে।

এখন তৃতীয় দফা ঋণ ছাড়ের জন্য আলোচনা চলছে।

অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর পর শুরুতে বড় উল্লম্ফন অস্বাভাবিক বিষয় নয়।

‘তবে অন্য সব কিছু ঠিক থাকলে দীর্ঘমেয়াদে ডলারের বাজারে স্থিতাবস্থা আনতে এটি সহায়ক হবে। যদিও এটি নিশ্চিত করতে হলে হুন্ডি কিংবা ডলারের এ ধরনের বাজার বহির্ভূত যে লেনদেন সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মোয়াজ্জেম।

এদিকে, ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্যের বাজারে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি নিয়ন্ত্রণে মনিটরিংয়ের গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

‘পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে সরকারের উচিৎ শক্ত ব্যবস্থা নেয়া। তা না হলে বাজার আরো অস্থির হয়ে উঠতে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন হোসেন।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশে মুসলিম কৃষকের ধানে আগুনকে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বলে প্রচার শিক্ষানুরাগী এস এম খলিলুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ সিরিয়ার নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেবে যুক্তরাষ্ট্র! ইতিহাসের প্রথম : ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক মাস্ক ২০৩৪ ফুটবল বিশ্বকাপ সৌদি আরবে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর সচল ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপ ভারতীয় মিডিয়াতে ইসকনের ওপর হামলার খবর ভুয়া : সিএ প্রেস উইং ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন মির্জা ফখরুল টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা ঢাকা সফর নিয়ে ভারতের এমপিদের ব্রিফ করলেন বিক্রম মিশ্রি রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন দুর্নীতি তদন্তে অগ্রাধিকার পাবে

সকল