২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নদীপথে নাব্যতা থাকলে বছরে ১৪০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে

নদীপথে নাব্যতা থাকলে বছরে ১৪০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে - ছবি : সংগৃহীত

নিয়মিত খনন বা ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নৌপথে নদীর নাব্যতা ধরে রাখার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা নদীতে ঢালা হচ্ছে। বছরের পর বছর চলছে এই নদী খনন বা ড্রেজিং প্রকল্পগুলো। নাব্যতা ফিরে আনা গেলে বছরে বিভিন্নভাবে এক হাজার ৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় নিশ্চিত হবে। কারণ সড়ক ও রেল পথের চেয়ে পণ্য পরিবহন খরচ নৌপথে অনেক কম। কৃষি ও মৎস্য খাত থেকে বছরে অতিরিক্ত আয় হবে এক হাজার ২০১ কোটি টাকা। এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। 

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, নৌপথে পরিবহন ব্যয়ও অনেক কম। প্রতি টন কার্গো পরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে যেখানে সড়কপথে ব্যয় সাড়ে ৪ টাকা। রেলপথে এই খরচ আড়াই টাকা এবং নৌপথে খরচ মাত্র ১ টাকা। অভ্যন্তরীণ নদীপথ ব্যবহার করার কারণে প্রতি বছর বাঁচানো যেতে পারে পাঁচ কোটি ৮৫ লাখ লিটার ডিজেল। প্রকৃতি বেচে যায় এক লাখ ৫৫ হাজার টন কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে। আর এ কারণে নৌপথ সংরক্ষণ করা না হলে ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। নৌপথগুলোর নাব্যতা রক্ষা করা গেলে কৃষিতে বছরে এক হাজার ১৯৭ কোটি আট লাখ ১৯ হাজার টাকা এবং মৎস্য খাতে তিন কোটি ৬৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত আয় হতো। আর নৌপথের মাধ্যমে ১৩৭ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার টাকা বছরে আয় আসত। ভাঙন প্রতিরোধের ফলে সাশ্রয় হতো ১১ কোটি ২১ লাখ ৫১ হাজার টাকা; অর্থাৎ শুধু ছয়টি নদীপথ খনন করে নাব্যতা ধরে রাখা গেলে বছরে প্রায় ১৪ শ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। 

জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ নৌপথ বাংলাদেশ পরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর অবদান অপরিসীম। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটার; যার মধ্যে পাঁচ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার বর্ষা মওসুমে এবং তিন হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার শুষ্ক মওসুমে নাব্যতা থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে সড়ক ও রেলপথ পৌঁছায়নি সেখানেও নৌপথ ব্যবহার করেও পৌঁছানো সম্ভব। বছরব্যাপী নাব্য নৌপথের আশপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়েই দেশের শতকরা ৫০ ভাগ অথনৈতিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ দেশের অভ্যন্তরে সুগভীর বিস্তৃত এই নৌপথ ব্যবহারের সুযোগ পায়। ফলে দিন দিন নদীপথের পরিমাণ যে হারে হ্রাস পাচ্ছে তাতে জরুরি ভিত্তিতে নৌপথগুলো ড্রেজিং করা না হলে অচিরেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু নাব্যতা বাড়ানোর জন্য ড্রেজিং কার্যক্রম নিয়েও তা নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়াতে জটিলতা বাড়ছে। ছয় বছরে যে ড্রেজিং কাজ শেষ করার কথা ছিল, তা এখন নয় বছরে গিয়ে ঠেকছে। 
বাংলাদেশ ইন্টেগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট সেক্টর স্টাডি-১৯৯৮ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সর্বমোট ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌ যোগাযোগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; যার মধ্যে আট হাজার কিলোমিটার নৌবহর ছিল ১৯৬৩ সালে, যা বাংলাদেশের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। ১৯৮৯ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিএইচভি অ্যাসোসিয়েট যখন ব্যাপক জরিপ করে তখন নৌপথের নাব্যতা কমে ছয় হাজার কিলোমিটার হয়। এই নদীগুলোর দ্বারা প্রতি বছর বন্যায় ৫০ লাখ কিউসেক পানি এবং ২৪০ কোটি টন পলি পরিবাহিত হয়, যা সারা বিশ্বের পরিবাহিত পলির সাড়ে ১৮ শতাংশ। ফলে নদীগুলো ক্রমান্বয়ে মৃত হয়ে পড়েছে। নাব্য নৌপথের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। তবে ১৯৮৯ সালের পর আর কোনো জরিপ না হওয়ায় বর্তমানে নদীর দৈর্ঘ্যরে কোনো দাফতরিক হিসাব নেই। পানিপ্রবাহ হ্রাস, ক্রস-বাউন্ডারি প্রবাহ হ্রাস, পলি প্রবাহ বৃদ্ধি এবং জোয়ারের প্রবাহ কম ইত্যাদি কারণে নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। 

নদী রক্ষা কমিশনের তথ্যানুযায়ী, নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে ছোট-বড় ও মাঝারি আকারের প্রায় সাড়ে সাত শ’টি নদী রয়েছে। কিন্তু ড্রেজিং ও অপরিকল্পিত ইন্টারভেনশনের কারণে দেশের প্রায় ২৩০টি নদী এখন মৃত। বর্তমানে নদীগুলো পলিউশন, সিলটেশন, তীর দখল, ব্লকেজ ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার বেশির ভাগ শিল্প নদীর তীরঘেঁষে স্থাপন করায় প্রতিদিন এক শ’ টন শিল্পের বর্জ্য নদীতে পড়ছে। 
এ দিকে আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহর ও শিল্পাঞ্চলগুলোর ৮০ শতাংশ পয়োবর্জ্য কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই নদীর পানিতে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে নদীগুলোতে রাসায়নিক পদার্থের দূষণ বাড়ছে। নদীর স্বাস্থ্য দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। নদী স্বাস্থ্যের অবনতির দিক থেকে শীর্ষে গঙ্গা অববাহিকার দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল। প্রতি বছরই নদীগুলো ড্রেজিংয়ের জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নেয়ার পরও অনেক নদী মরে যাচ্ছে; যা দেশের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

পরিবেশ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে ১৩ ফুট পুরু পলিথিনের স্তরে জমা হয়েছে। এগুলো অপসারণের কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। নদীতে কারখানার ৬০ ভাগ বর্জ্য, ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের ৩০ ভাগ বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। সরকারিভাবে নদী দূষণ করা হচ্ছে। নৌযানের বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। বুড়িগঙ্গার সীমানা পিলার সম্পর্কে তারা বলেন, শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে নদীর পিলার যথাস্থানে স্থাপন করা হয়নি। সীমানা পিলার স্থাপনের নামে তুরাগের অনেক এলাকা জমি বেদখল হয়ে গেছে। 

পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ড্রেজিং মেটারিয়াল বা উত্তোলিত বালু নদী বা নদীর পাড়ে না ফেলার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ড্রেজিং প্রকল্পে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ নদীতে ফেলা হয়েছে। ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ নদীর পাড়ে এবং ২৭ দশমিক ১০ শতাংশ কৃষিজমিতে ফেলা হয়েছে। এটা নদীতে বা নদীর পাড়ে না ফেলা উচিত। নির্দেশনা না পরিপালন করায় নদী আবার ভরাট হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement