লোকসানে বাংলাদেশ, সেই পাট নিয়েই যেভাবে লাভ করছে ভারত
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:২৯
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট দিয়ে তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বাস্তবতা হল বছরের পর বছর দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। অথচ ভারত বাংলাদেশ থেকে পাটের কাঁচামাল কিনে সেটা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিদেশ বিক্রি করছে এবং মুনাফা গড়ছে।
বাংলাদেশের এই পাটের খ্যাতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী। ফ্রান্সের প্যারিসে গত ৯ বছর ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন তৃণা খান।
সেখানে সেখানকার স্থানীয়দের নানান ধরণের পাটজাত পণ্য ব্যবহার করতে দেখেছেন।
অথচ পাট-পণ্য ব্যবহারকারী সেই বিদেশি ক্রেতাদের অধিকাংশই জানেন না এই পাটের উৎপাদন হয় বাংলাদেশে।
মিসেস খান বলেন, ‘আমি প্যারিসসহ আশেপাশের ছোট শহরগুলোতে মানুষকে পাটের জিনিসপত্র ব্যবহার করতে দেখেছি।’
‘এমনকি ফাইভস্টার হোটেলগুলোতেও দেখি আমাদের দেশের পাটের তৈরি কার্পেট। কিন্তু তারা এই সব জিনিসই কিনেছে ভারতের থেকে। কেউ জানেই না যে পাট বাংলাদেশে উৎপাদন হয়।’
বিশ্বের এমন নানা দেশে দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটের নানা ধরণের পণ্য। অথচ সম্ভাবনাময় এই খাতে বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে।
বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ২২টি পাটকলগুলো চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ৩৯৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং বিপণনে দক্ষতা না থাকার কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের পরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ।
‘বাজার ধরার মতো স্ট্রং মার্কেটিং আমাদের নেই, এটা পলিসি লেভেলের ব্যাপার। ভারত আধুনিক মেশিনে পাট প্রসেস করে বিদেশে রফতানি করছে। আর আমাদের মেশিন সেই মান্ধাতার আমলের।’
‘এছাড়া পাটকলগুলোয় দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। আমাদের দক্ষ লোক দরকার। দক্ষ বলতে, টেকনিকাল ম্যানপাওয়ার।’
পাটের উৎপাদনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় দেশ হলেও পাটের বর্তমান বিশ্ব বাজার দখল করছে ভারত।
বাংলাদেশে উৎপাদিত এসব পাটের কাঁচামাল ভারতেই সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় এবং বিদেশি ক্রেতারা এই পণ্যগুলো সরাসরি বাংলাদেশ থেকে নয় বরং ভারতের কাছ থেকে কিনে থাকে।
ফলে বাংলাদেশ পাট প্রক্রিয়াজাত করে লাভ গুনছে ভারতের বাজার। প্রধানত বৈদেশিক চাহিদা অনুযায়ী তৈরি পণ্য রফতানি সেইসাথে সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে সেটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন পশ্চিমবঙ্গের পাট ব্যবসায়ী তপন দাস।
‘ভারত পাট আমদানি করে সেটা নিজেদের মেশিনে প্রসেস করে পণ্য বানায় বিক্রি করে। আর তারা তাদের নিজেদের পুরো বাজারের চাহিদা নিজেরা মেটায়। তার মানে তাদের একটা মার্কেট প্রটেকশনের জায়গা পাচ্ছে।’
এছাড়া বিদেশী ক্রেতাদের সাথে দেন-দরবার করতে না পারা সেইসাথে সবচেয়ে ভালো মানের পাট রফতানি করে দেয়ার ফলে মানসম্মত পণ্য তৈরি করতে না পারায় বাংলাদেশ তার বাজার তৈরি করতে পারছে না বলে মনে করেন পাট পণ্যের উদ্যোক্তা শাফিয়া সামা।
‘ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় বড় দেশগুলোয় কার ইন্ড পাটের বড় একটা বাজার আছে। অথচ বাংলাদেশ সেই বাজারটা দখল করতে পারছে না দুটো কারণে।’
‘প্রথমত ভালো মান নিশ্চিত না করা ও দ্বিতীয়ত দাম নির্ধারণ করতে না পারা। বিদেশি বায়াররা এই দুটো জিনিসই সবার আগে দেখে।’
এছাড়া পাটচাষিদের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াকেও পাটের বাজার পড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ বলে তিনি মনে করেন।
অন্যদিকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পাটের বাজার পড়ে যাওয়ার পেছনে বিশ্বব্যাংকের একটি কারসাজিকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের বিপণন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ।
বিশ্বব্যাংকের সেই ফর্মূলায় বাংলাদেশের আদমজি জুটমিল বন্ধ হয়ে যায় এবং সে সময় বাংলাদেশের পুরো বাজার ভারত দখল করে নেয় বলে জানান তিনি।
‘২০০২ সালের দিকে আদমজি জুট মিল বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলায়। ওইসময় বিশ্বব্যাংকের লোনে ইন্ডিয়াতে বড় মিল স্থাপিত হয়েছে। এতে ইন্ডিয়া লাভবান হল, আমাদের সব বায়ার তারাই পেল।’
বর্তমানে বাংলাদেশে পাটের বহুমাত্রিক ব্যবহার দেখা গেলেও দৃশ্যপট খুব একটা বদলায়নি।
প্রতিবেদন : সানজানা চৌধুরী, বিবিসি বাংলা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা