স্বর্ণের ভরি কি ২ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮:০১
বিশ্ব বাজারে হু হু করে বাড়ছে স্বর্ণের দাম, যার সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের বাজারেও নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ে চলেছে মূল্যবান এ ধাতুটি। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আগামীতে স্বর্ণের ভরি বেড়ে কত হবে- সেই প্রশ্নটিই এখন জনমনে।
আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটের হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ প্রতি আউন্স (২ দশমিক ৪৩ ভরি) স্বর্ণের দাম বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৮০০ ডলার, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। বিশ্ববাজারের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের বাজারে সর্বশেষ ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের দাম দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯০ টাকা, দেশের ইতিহাসেও যা সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) তথ্যমতে, ২০০০ সালে দেশে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের ভরি ছিল ৬ হাজার ৯০০ টাকা। ২০১০ সালে তার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ১৬৫ টাকায়। এক দশক পর ২০২০ সালে ধাপে ধাপে স্বর্ণের দাম বেড়ে হয় প্রতি ভরি ৬৯ হাজার ৮৬৭ টাকা।
গত ১৫ বছরে দেশে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে করোনা ও করোনা পরবর্তী সময় মিলিয়ে গত ৪ বছরে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ভরিতে ৭৫ হাজার টাকা।
দেশের বাজারে সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুলাই মাসে স্বর্ণের ভরি ১ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। সে হিসাবে দেড় বছরে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ভরিতে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা।
যে হারে স্বর্ণের দাম বাড়ছে, তাতে করে ২০২৬ সালের শেষের দিকে স্বর্ণের ভরি দুই লাখের কাছকাছি পৌঁছাতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারে প্রায় পাঁচ দশক ধরে স্বর্ণের ব্যবসা করেন গোবিন্দ হালদার। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে দেশে গিনি সোনার দাম ছিল দেড় শ’ টাকা। বর্তমান বাজারে দেড় শ’ টাকা তুচ্ছ মনে হলেও ওই সময়েও মানুষের অভিযোগ ছিল, স্বর্ণের দাম নাগালের বাইরে। তবে বর্তমানে যেভাবে দাম বাড়ছে, তাতে করে বছর খানেকের মধ্যে ভরিপ্রতি ২ লাখ টাকাও হয়ে যেতে পারে।’
তবে সাধারণ মানুষের ভাষ্যমতে, দাম যতই নাগালের বাইরে থাকুক, স্বর্ণের চাহিদা কোনোদিন কমেনি।
দেশে স্বর্ণের দামের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, ‘স্বর্ণের ভরি ২০২৬ সালের দিকে ২ লাখের কাছাকাছি পৌঁছাবে কিনা সেটা হলফ করে বলা যায় না। তবে বিশ্ববাজারে যে হারে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে স্বর্ণ মজুত করছে, তাতে দাম ২ লাখ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’
তবে এটি বাজারের ওপরই ছেড়ে দেয়া ভালো বলে মনে করেন তিনি।
২০২৪ সালে দেশের বাজারে মোট ৬২ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছিল। যেখানে ৩৫ বার দাম বাড়ানো হয়, আর কমানো হয় ২৭ বার। চলতি বছর এখন পর্যন্ত চারবার স্বর্ণের সমন্বয় করে শীর্ষে অবস্থান করছেন মূল্যবান এ ধাতুটির দাম।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ২০২৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের পর থেকে ডলারের হিসাবে প্রতি বছর স্বর্ণের দাম ৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। দাম বাড়তে থাকায় এবং স্বর্ণকে মুদ্রায় রূপান্তর সহজ হওয়ায় দামের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাহিদা।
বিশ্ব বাজারে স্বর্ণের বার্ষিক চাহিদা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৩৪ টন, যার মূল্যমান ২৩৩ বিলিয়ন ডলার। উপমহাদেশে অলঙ্কার হিসেবে স্বর্ণ জনপ্রিয় হলেও বিশ্বের বহু দেশে স্বর্ণকে বিনিয়োগের বড় মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়।
স্বর্ণের ৪০ শতাংশ মজুত ব্যবহার করা হয় শুধু বিনিয়োগের উদ্দেশে, এর বিপরীতে গহনার পরিমাণ ৩৩ শতাংশ। এছাড়া, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হাতে আছে ২০ শতাংশ স্বর্ণের রিজার্ভ এবং প্রযুক্তি খাতে চিপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ৭ শতাংশ স্বর্ণ।
তবে স্বর্ণের বৈশ্বিক মজুতের হিসাব থাকলেও বাংলাদেশে এর কোনো সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব নেই।
এ ব্যাপারে মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ভারতে সাধারণ মানুষের হাতে কত টন স্বর্ণ আছে- তার একটি সরকারি হিসাব আছে। দেশটির মানুষ জানে, বিনিয়োগের বড় মাধ্যম স্বর্ণ এবং তাদের স্বর্ণে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করে রাষ্ট্র স্বয়ং। কিন্তু বাংলাদেশে স্বর্ণের ব্যক্তি পর্যায়ের মজুত নিয়ে কোনো সরকারি হিসাব নেই। এমনকি বাজুসের কাছেও এ নিয়ে সঠিক কোনো তথ্য নেই।’
করোনা-পরবর্তী সময়ে ডলালের দাম বাড়তে থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বর্ণকে নিরাপদ রিজার্ভ হিসেবে বেছে নিয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞাও স্বর্ণের বাজারে বড় প্রভাব ফেলেছে।
এছাড়া, কানাডা-মেক্সিকোর ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্কনীতিও স্বর্ণের বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে বাজুস।
দেশে সাধারণ মানুষের কাছে বিনিয়োগের উদ্দেশে স্বর্ণের মজুত কেন জনপ্রিয় নয়- এমন প্রশ্নের ব্যাখ্যায় বেশিভাগ মানুষই মনে করেন, যে হারে স্বর্ণের দাম বাড়ছে সেটি অযৌক্তিক। একসময় দাম কমে এলে তারা স্বর্ণ বিনিয়োগের উদ্দেশে কেনার চিন্তা করবেন। আবার স্বর্ণের মজুত কিভাবে বিনিয়োগের মাধ্যম হতে পারে- এ ব্যাপারটিও অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়।
করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসিবুর রহমান বলেন, ‘এককালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে স্বর্ণ উপহার দেয়ার প্রথা ছিল। এটা মূলত তাদের ভবিষ্যতের সঞ্চয়ের কথা ভেবেই উপহার দেয়া হতো। কিন্তু দাম বাড়ায় এ প্রথা একদমই উঠে গেছে। এখন গহনা দেয়ার বদলে টাকা দেয়ার প্রথা চালু হয়েছে।’
আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী রুম্মান রুবায়েত বলেন, ‘ব্যাংকে রাখা টাকা এবং এ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা অনেকাংশ ঝুঁকিমুক্ত। অন্যদিকে স্বর্ণের দাম এখন বাড়লেও আগামীতে কোনদিকে যাবে, সেটি নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। জমাকৃত অর্থের নিশ্চিত মুনাফার জন্যই মানুষ স্বর্ণ না কিনে ব্যাংকে টাকা রাখেন।’
তবে এ ব্যাপারে মানুষের সচেতনতা ও সঠিক আর্থিক জ্ঞান জরুরি মনে করেন বাজুস কর্মকর্তা মাসুদুর।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সাথে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষ নিশ্চিত ঝুঁকি জেনেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে। আগামীতে স্বর্ণের ভরি যতই হোক না কেন, স্বর্ণে বিনিয়োগ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন- আজ পর্যন্ত এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। শুধু সাজসজ্জার গহনা হিসাবে স্বর্ণ ব্যবহার না করে, বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে দেখলে মূল্যবান এ ধাতুর দাম বাড়লেও চাহিদা কমবে না।’
স্বর্ণের বাজারে ভ্যাট-ট্যাক্স সমস্যার সমাধান করা এবং সাধারণ মানুষকে স্বর্ণে বিনিয়োগ সুবিধাজনক- এমন বার্তা পৌঁছে দিতে পারলে বিশ্ব বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের বাজারে আগামীতে স্বর্ণের দাম যতই বৃদ্ধি পাক, চাহিদা কোনোদিনও তলানিতে ঠেকবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র : ইউএনবি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা